সাইকেল থেরাপি
সেদিনের সকালটা ছিল মেঘলা। তবে, গাছের পাতাও দুলছিল না। তাই, সরাসরি পুড়ে
যাবার হাত থেকে রেহাই থাকলেও, ভাপে সেদ্ধ
হয়ে যাবার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছিল। অনেকটা আজকের
মতই। উত্তরবঙ্গ সংবাদের নকুল বাবু এবং বাপ্পাদাকে
বিদায় জানিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়েছিলাম। সঙ্গে সদ্য ষোল বছরে পা দেওয়া আনন্দ। সপুত্র সাইকেল সফর। ইস্টার্ন
বাইপাস ধরে দক্ষিন মুখো যাবার পর সাহুডাঙ্গি রোড। তারপর রেললাইন টপকে, ক্যানালের
গা ঘেঁষে গজলডোবার পথে। বড় সুন্দর
রাস্তা। মন ভালো হয়ে গেল। দুজনে গলা ছেড়ে গান ধরলাম। আশেপাশে হঠাৎ এসে পড়া ঝুপড়ি দোকানের খদ্দের হাঁ করে আমাদের দেখতে লাগল। এমন কি দুয়েকটা গরু ছাগলও আমাদের বিচিত্র কান্ড দেখে ডাকতে ভুলে
গেল। আমরা এগিয়ে চললাম। তিস্তা ব্যারেজ পার হয়ে মাছ ভাজা খাব, এই সংকল্প।
শিমুলগুড়ির পর আমবাড়ির দিক থেকে আসা রাস্তাটা কখন আমাদের
পথে মিশে গেছে টের পাইনি। টের পাইনি
কখন আমাদের সঙ্গ নিয়েছে আর একটি সাইকেল। এমনিতে আমি বেশ ইন্ট্রোভার্ট। কয়েকজনের
মতে চূড়ান্ত অসামাজিক। তবে সাইকেল
চাপলেই আমার ব্যক্তিত্বে একটা আমূল পরিবর্তন আসে। মনটা কেমন যেন ফুরফুরে হয়ে যায়। কারনে-অকারনে লোক দেখলেই আলাপ করার ইচ্ছে উশখুশ করে। গান গাওয়ার কথাটা তো আগেই বলেছি। তাই মাঝে মাঝেই মনে হয় সাইকিয়াট্রিস্টরা তাঁদের মনমরা পেসেন্টদের ‘সাইকেল-থেরাপি’ প্রেসক্রাইব করেন না কেন? সাইকেল-থেরাপি যে ভয়ানক কাজে দেয় তা তো এই
শেষ জনগনতান্ত্রিক ভোটেই প্রমাণিত। নয় কি? তা হোক না সে যতই রদ্দি সাইকেল! থেরাপি তো?
যাইহোক, প্রাথমিক আলাপ বিনিময়ের পরেই এই নতুন সাইকেল
সঙ্গীটিকে আমার ভাল লেগে গেল। অবিকল যেন মালাউয়ির মিঃ ফ্লাইসন। সেদিন ফ্লাইসন খুড়ো
আমাকে জিগ্যেস করেছিল, আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে কি না? আফ্রিকায় সাইকেল নিয়ে
একটা বাদামি লোকের একলা টো-টো করা তার বোধগম্য হয় নি। তারপর অনেক হাহা-হিহি এবং
সাইকেল রেস। বন্ধুত্বের রেষ আর কাটে কোথায়?
আর আজ, এই তরাইয়ের ভাইটি আলাপ হওয়া মাত্রই তার গ্রামে
আমন্ত্রণ জানালেন। বললেন, গরীবের ঘর, কি আর খাওয়াতে পারি বলুন? চলুন শসা কেটে দেব।
এক ঘণ্টা জিরিয়েও নেবেন। আর সময় থাকলে নাওথুয়ার খালে স্নানটাও সেরে নিতে পারেন। যা
গরম! তুমি কি কর পরিমল? জিগ্যেস করতেই একগাল হেসে সে বলেছিল, কৈলাশপুর চা বাগানে
টেম্পোরারি লেবার বাবু। ১২২ টাকা রোজ। তাও সবসময় দেয় না। তাই হায়দ্রাবাদে কাজ
দেখছি। ভাইপো গেছে তো। জুটে যাবে আমারও কিছু একটা। আপনি শশা খান। আমার নিজের
ক্ষেতের জিনিষ। দাম লাগবে না।
আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। সাইকেল-থেরাপি আর কাজ করছিল
না।
ছবিঃ লেখক
Comments