হুইস্কি নিয়ে 'পিট'-পিটানি

পিট (Peat) ব্রিকস বানানোর কাজ চলছে। ছবিঃ findrarewhisky.com

এই লেখার নায়ক 'পিট' এবং গল্পের পটভূমিকা 'হুইস্কি'।  যদি 'পিট' সম্পর্কে আগ্রহী থাকেন তাহলে এই লেখার শেষে কয়েকটা লিংক দেওয়া আছে- সেগুলো পড়ে জানা আরম্ভ করতে পারেন। হুইস্কি না হয় নাই খেলেন- জানতে তো আর বাধা নেই। স্বয়ং মার্ক টোয়েন কী বলেছিলেন মনে আছে তো? সেই যে- “Too much of anything is bad, but too much good whiskey is barely enough.”



আমরা সকলেই আজকের সমাজে লিঙ্গবাদ, বর্ণবাদ এবং অন্যান্য ধরনের বৈষম্য হ্রাস দেখতে চাই। হ্যাঁ চাই। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রত্যহ ঘটে চলা 'ক্যানসেল কালচার' প্রসূত 'মব জাস্টিস' গোছের পদ্ধতিতে চাই কি? একমাত্র সেটাই কি আজকের "হাতে-রইল-পেন্সিল-অস্ত্র' ( পড়তে হবে 'ফেসবুক কিংবা টুইটার')"? 

আমরা জানি, সোশ্যাল মিডিয়া কয়েক মিনিটের মধ্যে এক টুকরো ভিডিওকে 'ভাইরাল' করে দিতে পারে। ঘটনার পিছনে থাকা মৌলিক তথ্যগুলি প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই দর্শকরা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়ে 'তিনদিনের জেল এবং সাতদিনের ফাঁসি'-র রায় ঘোষণা করে দিতে পারেন।  তার ফলে হারভে ওয়াইনস্টিন গোছের নরকের কীটের পতন যেমন হয়, ঠিক সেরকম বহু নিরীহ লোকের জীবনও বিপর্যস্ত হয়ে যায়।

Mob law is the most forcible expression of an abnormal public opinion; it shows that society is rotten to the core. - Timothy Thomas Fortune

এদিকে হয়েছে কী, বড় বড় কোম্পানি সমাজে ( মানুষের সমাজ এনাদের কাছে বাজার। এখানে নাগরিক থাকেনা- থাকে কেবল ক্রেতা ) তাদের 'ইমেজ' ঠিক রাখার জন্য মাঝেমধ্যেই নানারকম প্রগতিশীল, সামাজিক দায়বদ্ধতা, পরিবেশ বান্ধব -  এই ধরণের ট্যাগ লাগানো  কাজে তাঁদের সমর্থন আছে বলে ক্রমাগত ইঙ্গিত দিচ্ছেন। বলাবাহুল্য, এগুলো সবই 'খাচ্ছি- কিন্তু- গিলছি- না' টাইপের ইঙ্গিত। ক্লাইমেট ক্রাইসিস, গ্লোবাল ওয়ার্মিং- এসব ব্যাপারেই সরকারের নীতি নির্ধারণ ঠিক করে দেয়  কর্পোরেট দুনিয়া। জানা গেছে, বিশ্বের বৃহত্তম ১০০ টি শিল্প- সংক্রান্ত কোম্পানিগুলির প্রায় পঞ্চাশ শতাংশই পরিবেশ বান্ধব আইন প্রণয়ন হতে দিতে চায় না। চাইলে এই ব্যাপারে আপনি অনেক তথ্য ইন্টারনেটে পেয়ে যাবেন। তবু একটা লিংক আমি এখানে দিলামঃ মিট দি হিপোক্রিটস  

২০১৫ সালে, নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি লেখায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক রস ডাউথার্ট এই ধরণের জাগ্রত বিবেক ধনতন্ত্রকে একটি যুতসই নাম দিয়েছিলেন এবং সেটি হল- '  Woke Capitalism' । বিবেক রামস্বামী ( আর একজন হার্ভার্ড এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক) তো এই বিষয়ে একটা গোটা বইই লিখে ফেলেছেন। বইটির নাম - “Woke, Inc.: Inside Corporate America’s Social Justice Scam.” 

এদিকে বিবিসি জানিয়েছে, স্কটল্যান্ডের হুইস্কি নির্মাতারা নাকি 'পিট' থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। কারণ, 'পিট' পদ্ধতি নাকি 'সাস্টেনেবল' নয়। আবার এও বলছেন, অদূর ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্ম নাকি পিট-বিহীন হুইস্কি বানানোর পদ্ধতিকেই বেছে নেবেন এবং স্বাদও মেনে নেবেন।  


আসলে পিটল্যান্ডগুলি একটি অনন্য ইকোসিস্টেম যা জীববৈচিত্র্যকে সমর্থন করে এবং কার্বন সিঙ্ক হিসাবে কাজ করে। পিটল্যান্ড খালি করার সময় জমি থেকে প্রচুর পরিমাণে সঞ্চিত কার্বন ডাই অক্সাইড বেরিয়ে যায়, যা গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা বাড়ায়। স্বাভাবিকভাবেই, পিট মাইনিং কার্যকরভাবে সাস্টেনেবল নয়,কয়লা বা তেলের মতোই পিটও একটি সীমিত সম্পদ। এটি পুনরুত্থিত হয় ঠিকই, কিন্তু হয় শুধুমাত্র বার্ষিক ১ মিমি হারে। 

পিটল্যান্ড- ছবি সৌজন্য- Global Peatlands Initiative

কিন্তু কথা হল, বিশ্ব ব্যাপী হুইস্কি শিল্প যে পরিমাণ পিটল্যান্ড ব্যবহার করে তা অত্যন্ত নগণ্য। পিটল্যান্ড বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অ্যাঞ্জেলা গ্যালেগো-সালা  বিবিসি-র রিপোর্টে  নিজেই বলেছেন- " "Globally, the whisky industry uses a tiny amount of peat ..." তবে আসল সমস্যাটা হল পিট-এর ব্রিক বার করতে গিয়ে গোটা পিটল্যান্ডের জলটাই বার করে দিতে হয়। ফলে, আবার অধ্যাপক গ্যালেগো-সালা বলেছেন, "You affect not just the area of extraction but the whole peatland, you break the ecosystem. You lose the biodiversity, the water cycling, the carbon cycling."


তবু, ধর্মাবতার আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, হুইস্কি নয়, সব থেকে বেশী পিটল্যান্ড ব্যবহার হয় বাড়ি বাড়ি উদ্যানপালনে। ঠিক ধরেছেন, পাড়ায় পাড়ায় যে নার্সারি শিল্প-সেখানে। এই দেখুন বিলেতের এক বিখ্যাত কাগজ কী বলছে- পিট কেন পরিবেশের জন্য খারাপ । আবার ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে “5% of human-caused carbon emissions” আসে পিটের ধোঁয়া থেকে (এই যে লিংক )। তবে তার জন্য মুখ্যত দায়ী হর্টিকালচার শিল্প। তাই পিটল্যান্ড বাঁচানো দরকার ঠিকই, কিন্তু প্রথম বলিদান হুইস্কিকে কেন দিতে হবে? 


হুইস্কি উৎপাদনে পিট ব্যবহারের ওপর এমন লঘু পাপে গুরু দণ্ড কেন? দুয়েকটা ছোট ছোট দ্বীপে ( এবং দ্বীপানু) বংশানুক্রমে কিছু মানুষ অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে যে পিটেড হুইস্কি বানিয়ে আসছেন তা তো এক কোথায় অনবদ্য শিল্প! অতএব, সবার আগে বাড়ির বাগানে নজর দিন। 


আমার কাছে অবশ্য এই ' হুইস্কিতে-পিটের-ধোঁয়া-দরকার-নেই' ন্যারেটিভটাই একটা ধোঁয়া- একটা 'smokescreen' । নতুন একটা ব্র্যান্ড বাজারে আনার এবং পরিবেশ বান্ধব তকমা লাগিয়ে বেশী দামে বেচার একটি কৌশল। যেমনটা, কেবল হুইস্কি নয়, আর পাঁচটা পণ্যের সঙ্গে নিত্যই ঘটে থাকে। 


প্রাত্যহিক সব কেনাবেচাতেই আমাদের, অর্থাৎ ক্রেতাদের বোঝানো হয়, কী সাংঘাতিক ভাল আমার বিক্রেতা। পৃথিবীকে আমার প্রিয় কোম্পানি কিংবা ব্র্যান্ড কতই না ভালবাসেন! বিজ্ঞাপন দেখে মনে হয় যেন পুরো দধীচি লেভেলে এই কোম্পানিগুলোর আত্মত্যাগ। 


 কিন্তু তাঁদের আসল উদ্দেশ্য যে আরও মুনাফা তা তো সর্বজনবিদিত।  

তাই পিট নিয়ে এই সংবাদ মাধ্যমে পিটপিটানি দেখে আমার ভয় একটাই--woke capitalism -এর যা দাপট, তাঁরা চাইলেই যত্রতত্র 'মব জাস্টিস' ঘটাতে পারেন এবং সেই বিজয় উল্লাসে প্রাচীন পিটেড হুইস্কির ট্র্যাডিশনও না 'ক্যান্সেল' হয়ে যায়!  

তবে না, আমি  'war on woke' (WOW) এর দলের কেউ নই । পিটমুগ্ধ এক গুণগ্রাহী মাত্র। 

All you need to know about Peated Whisky

Everything You Need to Know About Peat in Whisky




Comments

Popular posts from this blog

Across The Sahara on a Bicycle

To the Mountains of the Moon: A Journey from Fiction to Facts

Straight from a Story Book: Part I