অরণ্যে রোদন
সবসময় নয়, তবে মাঝেমধ্যে কিছু লেখার একটা তাগিদ আমার মধ্যে কাজ করে বলেই একসময় https://himalaya-raja.blogspot.com/ এই ব্লগ পেজটা খুলেছিলাম। নাম দিয়েছিলাম- 'Soliloquy of a Wandering Pilgrim or In Dialogue with Destiny' ।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে এটি একটি বিচিত্র নাম। এই বলছি 'সলিলোকি', আবার পরমুহুর্তে বলছি 'ডায়ালগ'। আসলে আমার মনে হয়েছিল স্বগতোক্তিও একধরণের আলাপচারিতা হতে পারে- হোক না তা নিজের সঙ্গেই। নিজের ব্লগে লিখতে পয়সা লাগে না এবং কাউকে জবাবদিহিও করতে হয় না! তাই জন্যই আমার এই ব্লগ পেজ। নিজের যা খুশী, যখন খুশী লিখব- এই ভেবেই খুলেছিলাম। আবার যদি কোনদিন ইচ্ছে হয় তখন বন্ধ করে দেব লেখা। কেউ তো মাথার দিব্যি দেয়নি যে লিখতেই হবে।
সেইরকমই একটা ছোট লেখা কয়েকদিন আগে লিখেছিলাম এখানে। নাম দিয়েছিলাম-'ইন্দ্রবর্মার হাতি'। বাংলার পর্বতারোহণের ভাগ্যাকাশে ঘটে যাওয়া ইদানীংকালের একটা ভেল্কিবাজি ছিল সেই লেখার বিষয়। (প্রসঙ্গান্তরে বলে রাখি বাংলার আট হাজার মিটারি পর্বতারোহণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে এরকম আরও বেশ কিছু ভেল্কিবাজির ঘটনা রয়েছে)
যাইহোক, ইন্দ্রবর্মার সেই হাতি নাকি পর্বতারোহীঠাসা দুয়েকটা সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপেও পৌঁছেছিল। কিন্তু সেই লেখা পড়ে কারও কিছু আসে যায়নি। কেউ কোন মন্তব্যও করেননি- স্রেফ অগ্রাহ্য কিংবা উপেক্ষা করে গেছেন। পাহাড়িয়া লোকজনের এইরকম নির্বিকল্প সমাধী দেখে আমার কয়েকজন হিমালয়প্রেমী বন্ধু অবাক হলেও, আমি হইনি। বরং ভারী আমোদ হয়েছিল এই ভেবে যে- বাংলার পর্বতারোহণ জগতে আমার 'ইন্দ্রবর্মার হাতি' ইংরাজি বাগ্ধারা '(The) Elephant in the room'- এর সত্যতা প্রায় আক্ষরিক অর্থেই প্রমাণ করতে সফল হয়েছে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আসলে গোড়ায় গলদ হয়েছে 'মাউন্টেনিয়ারিং ট্যুরিজম' এবং 'মাউন্টেনিয়ারিং'- এই দুটো ব্যাপারকে জনমানসে সমার্থক হয়ে যেতে দেওয়ায়। সোনা এবং সোনার পাথর বাটিকে তো একই গোত্রে ফেলে দিয়েইছো- এবার বোঝো ঠ্যালা! কী ভাবে এই ভাবের ঘরে চুরি হল সেই নিয়ে একটা বিস্তারিত আলোচনা অন্যত্র করা যেতে পারে এবং পাঠকদের মধ্যে কেউ এই নিয়ে সত্যিই পড়াশুনো করতে চাইলে অনেক উপাদান তাঁদের নাগালের মধ্যেই পেয়ে যাবেন।
তাই আর বিশদে না গিয়ে বলতে চাইছি, মধ্যমেধার নবজাগরণ, সোশ্যাল মিডিয়ায় তার অসীম ক্ষমতায়ন এবং তার গণ-উদ্যাপনের ফলে আর পাঁচটা বিষয়ের মতই নাভিশ্বাস উঠেছে পর্বতারোহণের দর্শনেরও। ম্যালোরির ‘বিকজ় ইট ইস দেয়ার’ কিংবা চেস্টারটনের ‘থিং’ — সবকিছুরই প্রকৃত অর্থ হারিয়ে গেছে। একটা অস্পষ্ট দর্শনের ( Philosophy of fuzziness) পতাকা পতপত করে উড়ছে সর্বত্র। তাই 'almost done' টাও 'done' হয়ে যাচ্ছে নির্বিরোধে এবং নির্বিচারে চলে আসছে সংবাদ শিরোনামে। একটা মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে সত্যে।
হাই- অলটিচিউড মাউন্টেন ট্যুরিজম ভালো, পর্যটন শিল্পের জন্য ভালো, পর্যটন কর্মীদের জন্য ভালো, পাড়ায় ফিরে কলার তুলে হাতির পিঠে চেপে সম্বর্ধনা নেবার জন্য ভালো- কিন্তু তাই বলে টুরিস্ট মাউন্টেনিয়ার কখনই প্রকৃত মাউন্টেনিয়ার হয়ে যায় না। জেফ বেজোস কিংবা ইলন মাস্কের রকেট চেপে মহাকাশ সফর সেরে এলেই যেমন কেউ নভশ্চর হয়ে যান না, ঠিক সেরকম কোন ট্র্যাভেল এজেন্সির প্যাকেজ ট্যুরে এভারেস্ট ( এবং তারপর ফি-বছর আরও ৮০০০ মিটারি) চড়েও কেউ মাউন্টেনিয়ার হয়ে যান না।
তবে কিছুটা দুঃখজনক স্বান্তনার কথা হল যে, এই টুরিস্ট ক্লাইম্বিং-এর উপদ্রব কেবল বাংলায় নয়, সারা বিশ্বেই বেড়েছে কমবেশি। এই সামুহিক অবক্ষয়ের অভিমুখ দেখেই ২০০২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্লাইম্বিং অ্যান্ড মাউন্টেনিয়ারিং ফেডারেশন (Union Internationale des Associations d'Alpinisme- UIAA) এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করেন যা আজ ‘দি টিরল ডিক্লেয়ারেশন’ নামে পরিচিত। টিরল ঘোষণায় একটা কথা পরিষ্কার ভাবেই বলা হয়েছে, “বিপদ এবং অনিশ্চয়তা ব্যতীত ক্লাইম্বিং তার প্রকৃত পরিচয়, তার সংজ্ঞায়িত উপাদান হারায়— এবং তা হল অ্যাডভেঞ্চার”। “Without danger and uncertainty climbing loses its defining element-adventure”।
এজেন্সিরা যে প্যাকেজগুলি বিক্রি করেন তার নাম 'অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম', 'অ্যাডভেঞ্চার' নয়- তা সে মাউন্ট এভারেস্টও হতে পারে, সেভেন সামিটস হতে পারে, আবার এক্সপ্লোরার্স গ্র্যান্ড স্ল্যাম-ও হতে পারে। যেমন গালভরা প্যাকেজের নাম, তেমনই যুতসই তার দাম। এই পদ্ধতিতে পাহাড় চড়ে (কিংবা মেরু বিজয় করে) কারও ব্যক্তিগত শখ মেটে বটে, তবে তা সমাজকে কিছু দেয়না। তাই কেউ নিজের কিডনি বেচে, কিংবা বাপের জমি বন্ধক রেখে এজেন্সিকে পয়সা দিতে পারছে, কি পারছে না, তা কখনই একটা সামুহিক বিবেচ্য বিষয় কিংবা সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিচায়ক হওয়া উচিৎ নয়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
কিন্তু এতসব কিছু জানা সত্ত্বেও যখন সেই টুরিস্ট ক্লাইম্বিং-কেই একটা সমাজ ফুলমালা দিয়ে, রেকারিং ডেসিম্যালের মত বরণ করে নিতেই থাকেন, তখন প্রশ্ন জাগে আমরা কি সত্যিই খাঁটি জিনিষ পেতে আগ্রহী?
নাকি, আমাদের সামুহিক হতাশা এবং দূর্দশা আজ এতটাই যে 'নাকের বদলে নরুন' পেয়েই আমাদের এই গণ টাক-ডুমা-ডুম উৎসব সমানে চলিতেছে?
আবার কখনও এও মনে হয়, আজ আমাদের পাহাড়িয়া সমাজ সেই 'ম্যাড কাও' রোগে আক্রান্ত গরুটি যে নিজের স্বরূপ ভুলেই গেছে এবং তাই তার আর কোন দুশ্চিন্তাও নেই এবং স্বাভাবিকভাবেই সে সব কিছুর উর্দ্ধে এক তুরীয় অবস্থায় পৌঁছে গেছে।
"সুখী, সবাই সুখী, জয় তারা!"
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
Comments