Skip to main content

পর্বতারোহণঃ একটি ছিন্নডানা স্বপ্ন- প্রথম পর্ব

পর্বতারোহণঃ একটি ছিন্নডানা স্বপ্ন -(প্রথম পর্ব)

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়

(লেখকের মন্তব্যঃ এই লেখাটি দেশ পত্রিকায় ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। সম্পাদকের অনুমতি নিয়ে এবার নিজের ব্লগে দুটি পর্বে প্রকাশ করলাম। এটি প্রথম পর্ব। কৃতজ্ঞতা এবিপি প্রাইভেট লিমিটেড। ) 




পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে, ইওরোপ-আমেরিকার পাহাড়িয়া আড্ডায়, পোড় খাওয়া এবং পোড় খেতে উদ্‌গ্রীব পর্বতারোহীদের মুখে মুখে একটা আলোচনা খুবই শোনা যেত আল্পসের শামোনি কিংবা ওয়েলসের প্লাস--ব্রেনিন, মাল্টি-পিচ কিংবা কোনও বোল্ডারিং সমস্যার শেষে, গ্রামের শুঁড়িখানায় বিয়ারের গ্লাসে ফেনার মতোই উপচে পড়ত একটা সম্ভাবনার কথা শোনা যেত, হিমালয় এবং কারাকোরামের উচ্চতম সবক’টি পাহাড় আরোহণ হয়ে গেলেই, পর্বতারোহণের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হবে বলা হত, তখন আর হাল্লা-চলেছে-যুদ্ধের কায়দায় বিশাল আকার-প্রকারের অভিযান সংগঠিত হবে না তখন কেবল গুটিকয় বন্ধু, পেল্লায় স্যাক কাঁধে তুলে নিয়ে, অপেক্ষাকৃত ছোট পাহাড়ে, কঠিনতর ক্লাইম্বিং চ্যালেঞ্জের সন্ধানে পাড়ি দেবে। স্নোডনিয়া, লেক ডিস্ট্রিক্ট, কানাডিয়ান রকিস, সিয়েরা ক্যাসকেডস থেকে জারম্যাট-গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের পাথর-বরফে ঘষা খেয়ে প্রতিনিয়ত উদ্ভাবিত হয়ে চলা নতুন ক্লাইম্বিং পদ্ধতি, শৈলী এবং সরঞ্জামের যথার্থ প্রয়োগের ক্যানভাস খুঁজে বেড়াবে এই নতুন প্রজন্মের পর্বতারোহীরা, হিমালয় এবং কারাকোরাম জুড়ে। বলা হত, আফটার অল, ক্লাইম্বিং ইস অলসো আ ফর্ম অফ আর্ট এবং আর পাঁচটা আর্ট ফর্মের মতোই পর্বতারোহণও বিবর্তিত, উন্নত, আধুনিক হবে এবং মানুষকে ভাবতে বাধ্য করবে

১৯৫৬ সালে, আজকের গিলগিট বাল্টিস্তান এবং শিনচিয়াং সীমান্তে মুজতাঘ টাওয়ারে ব্রিটিশ অভিযানের সাফল্য দেখিয়ে দিয়েছিল কারাকোরাম বা হিমালয়ের মতো প্রত্যন্ত পর্বতমালায়, ৭০০০ মিটারের শৃঙ্গে, কলোনিয়াল ঘরানার বাহুল্য বর্জন করেও অতি উচ্চ মানের টেকনিকাল ক্লাইম্বিং কী ভাবে করা যায় ৭ জুলাই, ইয়ান ম্যাকনট-ডেভিস এবং জো ব্রাউন মুজতাঘ টাওয়ারের পশ্চিম শিখর আরোহণ করেছিলেন এবং ঠিক তার পরদিন, টম প্যাটি এবং জন হারটগ সেই একই রুটে মুজতাঘ টাওয়ারের পশ্চিম এবং পূর্ব সামিট ট্র্যাভার্স করেছিলেন। প্রখ্যাত পর্বতারোহী ট্রেভর ব্রাহাম ‘দি অ্যাল্পাইন জার্নালে’ লিখেছিলেন, “১৯৭০ সালের অন্নপূর্ণা সাউথ ফেস ক্লাইম্বের থেকেও, সময় এবং পরিস্থিতির বিচারে ১৯৫৬ সালের এই ক্লাইম্ব প্রকৃত অর্থেই পথপ্রদর্শক ছিল” তার ঠিক পরের বছরই আরও এক নতুন ধরনের হাই-অল্টিচিউড ক্লাইম্বিং পদ্ধতি দেখা দিয়েছিল কারাকোরামে ৮০৪৭ মিটারের ব্রড পিকে। অস্ট্রিয়ার এই দলে ছিলেন মাত্র চারজন ক্লাইম্বার। কোনও শেরপা, হাই-অল্টিচিউড পোর্টার ইত্যাদি ছাড়াই ব্রড পিক আরোহণ করেও তাঁরা থেমে থাকেননিদল এবার দু’ভাগে ভাগ করে নিয়ে তাঁরা দু’টি ভিন্ন শৃঙ্গে আরোহণ শুরু করেছিলেন। দু’জন (মার্কাস শ্মুক এবং ফ্রিৎজ উইন্টারস্টেলার) আরোহণ করেছিলেন ৭৪২০ মিটারের এক অনামা শৃঙ্গ, আর অন্য দু’জন চেষ্টা করেছিলেন চোগোলিসা (৭৬৫৪ মিটার) ক্লাইম্ব করারএই দ্বিতীয় দলে ছিলেন হারমান বুল এবং কুর্ট ডিয়েমবার্গার। দুর্ভাগ্যক্রমে এই চোগোলিসাই ছিল প্রবাদপ্রতিম হারমান বুলের শেষ ক্লাইম্ব। কিন্তু, শিখর গিরিশিরার কর্নিস ভেঙে বুলের মতো পর্বতারোহীর চিরতরে হারিয়ে যাবার পাশাপাশি যে-স্বপ্নটা বিশ্বের পর্বতারোহীদের মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল, তা হল— কয়েকজন বন্ধু মিলে হিমালয়-কারাকোরামের মতো বৃহত্তর পর্বতমালায় গিয়ে তাহলে কেবল একাধিক টেকনিকাল শিখরই নয়, আট হাজারি শৃঙ্গও ‘হারমান বুল স্টাইলে’ আরোহণ করা সম্ভব। এই চালচিত্র থেকে জাম্প-কাট করে যদি চলে আসি ১৯৮১ সালে, নন্দাদেবী স্যাংচুয়ারির দক্ষিণ দেওয়ালে, তাহলে দেখতে পাব বিদ্যুৎ সরকারের নেতৃত্বে মাইকতোলি সহ মোট তিনটি বাইশ হাজার ফুটের শিখর আরোহণ করছেন গৌতম দত্ত এবং অমূল্য রায়। করছেন কোনও শেরপা কিংবা হাই-অল্টিচিউড পোর্টারের সাহায্য ছাড়াই। রামধনুর দুই প্রান্তের মতোই কারাকোরামে হারমান বুলের জন্ম দেওয়া স্বপ্নের ক্লাইম্বিং ঘরানা এবং দর্শন মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছিল বাংলার এই পর্বতারোহীদের আইস-অ্যাক্সে ভর করে।

ইয়োরোপের আরও এক দশক পরে, অর্থাৎ, ষাটের দশকের শেষ দিকে এই বহুলচর্চিত সম্ভাবনার রশ্মি আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গেও এসে পৌঁছেছিল। ভারতের মধ্যে বাংলাই যে এই বিষয়ে অগ্রণী ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বইয়ের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক যে অনেক পুরনো! রামানন্দ ভারতী, সুকুমার বসু, শঙ্কু মহারাজ তো ছিলেনই, তবে সবার ওপরে এক নির্ভরযোগ্য ছাতার মতো ছিলেন উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর সাগ্রহ পথপ্রদর্শনেই গড়ে উঠেছিল পশ্চিমবাংলার পর্বতারোহণে পথিকৃৎ একটি ক্লাব, হিমালয়ান ইনস্টিটিউট (পরে অ্যাসোসিয়েশন)। বিশ্বের প্রায় প্রত্যেক স্বনামধন্য পর্বতারোহীর জীবনে অনুঘটকের ভূমিকায় আছে পর্বতারোহণ-সাহিত্য। অ্যালবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিফেন স্লেমন ‘অ্যাল্পিনিস্ট’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে সম্প্রতি লিখেছেন, “Most climbers aren’t born to the mountains: they read their way into them” বাংলার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেরকমই হয়েছিল হিমালয়ের কোলে কিংবা নিদেনপক্ষে পাদদেশে না জন্মেও, পর্বতারোহণ-সাহিত্যের হাত ধরেই দুনিয়া জুড়ে ক্লাইম্বিং-এর হালহকিকত বাঙালি অনুধাবন করেছিল ভারতের অন্য প্রদেশগুলির আগেই।

জো ব্রাউন আর ইয়ান ম্যাকনট-ডেভিস কিংবা জো টাস্কার আর পিটার বোর্ডম্যানের নাড়ির খবর বাংলার কিছু ক্লাইম্বার তখনই রাখতেন। ফলে, সবরকম প্রাদেশিকতার ঊর্ধ্বে উঠে আজ একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সাহিত্যের আলোকে অনুপ্রাণিত হয়েই সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশক জুড়ে বাংলায় এসেছিল হিমালয়ের ক্যানভাসে অ্যাল্পাইন স্টাইলে পর্বত আরোহণের আর্ট এবং শেরপাদের কাঁধে ভর না করে নিজেদের ক্ষমতায় শিখর আরোহণের প্রচেষ্টা। সম্ভাবনাময় নতুন সেই অধ্যায়কে দীর্ঘজীবী করার রোমান্স থেকে বাঙালি বাদ যায়নি। বিদ্যুৎ সরকার, গৌতম দত্ত, প্রদীপ দাস, বনভূষণ নায়ক, অমূল্য রায়ের মতো আরও বেশ কিছু নাম দূরের তারার মতো চিকচিক করে উঠেছিল। তিরিশের দশকে হিমালয়-কারাকোরাম-আফ্রিকা দাপানো প্রবাদপ্রতিম জুটি এরিক শিপটন এবং বিল টিলম্যানের মতো, আটা ভাজা, ছাতু আর পাটালিগুড়ে হিমালয় ডিঙোনোর শক্তি, ’৭০-’৮০র দশকের এই একঝাঁক বাঙালি ক্লাইম্বাররাও আপন করে নিয়েছিলেন। অথচ আজ, এই ২০২০ খ্রিস্টাব্দে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতেই হয় যে, পর্বতারোহণের আধুনিক ধারায় পা রেখে নতুন অধ্যায়ের সূচনা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নিনা, কেবল, এই বাংলা তথা ভারতবর্ষেই যে পর্বতারোহণের সেই প্রতিশ্রুত, যুগান্তকারী অধ্যায় আসেনি তা নয়; গোটা বিশ্বেই আসেনি। তার অন্যতম কারণ হল, বিগত তিন দশকে এই জমিতে বেনো জল ঢুকেছে বাঁধভাঙা বন্যার মতো। ফলে, পর্বতারোহণ জগতে নবাগতের পদার্পণ এবং যথাসময়ে উত্তরণের মুখ্য দার্শনিক শর্ত এবং তার উদ্দেশ্যের বিশুদ্ধতা বিষিয়ে গেছে। স্যার এডমন্ড হিলারি, ক্রিস বনিংটন, ডগ স্কট, ট্রেভর ব্রাহাম, জো ব্রাউন, ইভন শুইনা, রাইনহোল্ড মেসনার থেকে স্টিফেন ভেনাবলস— এঁরা সকলেই সহমত এই একটা ব্যাপারে।

নব্বইয়ের দশকে রব হল-গ্যারি বলের হাত ধরে সেই যে মাউন্ট এভারেস্টের গায়ে ‘ফর সেল’ তকমা লেগেছিল আজ তা এক অতিমারির রূপ নিয়েছে। প্রথমে বাছা বাছা কিছু পাহাড়কে (যেমন কিলিমানজারো, ম্যাটারহর্ন, আকোঙ্কাগুয়া, এলব্রুস এবং মাউন্ট এভারেস্ট) ব্র্যান্ডিং করা হয়েছিল এবং তাদের পণ্য করে ইওরোপ এবং আমেরিকায় একের পর জন্ম নিয়েছিল অ্যাডভেঞ্চার বেচার কোম্পানি— অ্যাডভেঞ্চার কনসালট্যান্টস, মাউন্টেন ম্যাডনেস, জ্যাগেড গ্লোব, অ্যাল্পাইন অ্যাসেন্টস ইত্যাদি তারপর, কয়েক বছর যেতে না যেতেই জন্ম নিল লোবেন এক্সপিডিশন, সেভেন সামিটস ট্রেকসের মতো অপেক্ষাকৃত সস্তা দামের এবং নিম্ন মানের নেপালি কোম্পানিগুলি এভারেস্ট এবং সমগোত্রীয় সব ক’টি শৃঙ্গ পরিণত হয়েছিল ইন্ডাস্ট্রিতে বলা হয়েছিল, স্বপ্ন সম্ভবের যুগ এসেছে, ফেলো কড়ি চড়ো এভারেস্ট— ব্যস, তুমিও রাতারাতি পরিচিত হবে অভিযাত্রী হিসেবে বলা বাহুল্য, এমন বিজ্ঞাপনে এসেছিল প্রবল সাড়া প্রথমে ভিড় সামলাতে এবং তারপর সেই খদ্দের ধরে রাখতে, কয়েক বছর পার হতে না হতেই প্রয়োজন হয়েছিল ব্র্যান্ড এক্সটেনশনের ফলে সৃষ্টি হয়েছিলসেভেন সামিটস’, ‘এক্সপ্লোরার্স গ্র্যান্ড স্ল্যামগোছের গালভরা নামের প্যাকেজ ট্যুর প্রথম দিকে এই সব বিজ্ঞাপনের টার্গেট অডিয়েন্স সীমাবদ্ধ ছিল আর্থিক ভাবে সচ্ছল প্রথম বিশ্বের মানুষজনের মধ্যে এভারেস্টের এমআরপি ৬৫ হাজার ডলার ছুঁয়েছিল আর এখন বাংলার গ্রামের ছেলে বা মেয়েটি তার মায়ের গয়না, বাপের জমিজমা বন্ধক দিয়ে, যে-কোনও মূল্যে একটা আট হাজারের শিখরে উঠতে চাইছে কারণ, সে দেখতে পাচ্ছে এভারেস্ট বা সমতুল কিছু পাহাড়ে একবার উঠতে পারলেই টিভি এবং খবরের কাগজের হেডলাইন হওয়া এ পোড়া দেশে নিশ্চিত তার হয়তো মনে হয়েছে, মিডিওক্রিটি থেকে মুক্তি পাবার এটা একটা নতুন শর্টকাট পর্বতারোহণের বাণিজ্যিক প্যাকেজিং-এর সাফল্য তাই আজ এক অতি-ছোঁয়াচে সংক্রমণ। এক প্যানডেমিকের মতোই এই সংক্রমণ আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সব পর্বতমালায়, এমনকী দুই মেরুও বাদ যাচ্ছে নাএভারেস্ট, অন্নপূর্ণা, কাঞ্চনজঙ্ঘা, মানাসলু, চোইউ, ধৌলাগিরি, লোৎসে ইত্যাদি শিখরের কথা বাদই দিলাম, বাণিজ্যিক প্যাকেজিং-এর থাবা কে-টু কেও ছাড়েনি। বিগত দশ বছরে এই পশ্চিমবাংলা থেকে আট হাজারি শৃঙ্গ ‘জয়’ করতে যাওয়ার মিছিল তাই কোনও যুগান্তকারী ঘটনা নয়— বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় অযোগ্য, না হয় ট্যুরিস্ট ক্লাইম্বারদের (ক্ষেত্র বিশেষে দু’টিই) ইগো ট্রিপ। বাঙালির আট হাজারি শৃঙ্গের অভিমুখে যুদ্ধ ঘোষণার হিড়িক, সেই মাপকাঠিতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং সেই দুর্ঘটনাগুলির কারণ বিশ্লেষণ করে ‘ড্রিম ওয়ান্ডেরলুস্ট’ নামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রূপক ভট্টাচার্যের একাধিক নিবন্ধ এ বিষয়ে একাধারে একটি ‘মেটিকুলাস’ ময়নাতদন্ত সিরিজ এবং সতর্কবার্তা   আট হাজার মিটারের পাহাড়ে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পর্বতারোহীদের দূর্ঘটনার বাৎসরিক পুনরাবৃত্তির কারণ যে মূলত সাবজেক্টিভ হ্যাজার্ড, সে প্রসঙ্গে ডঃ ভট্টাচার্য একজায়গায় লিখেছেন, “পর্বতারোহণ ঝুঁকির খেলা। এতে দুরকম প্রতিবন্ধকতা, অবজেক্টিভ এবং সাবজেক্টিভ। প্রথমটি পাহাড়জনিত, তার উচ্চতা, কাঠিন্য, আবহাওয়া ইত্যাদি। দ্বিতীয়টি পর্বতারোহীজনিত, তাঁর শিক্ষা, মানসিকতা, স্বাস্থ্য, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। তাই পাহাড়ে ঘটা যেকোনো দূর্ঘটনার কারণ বিচার করতে হবে এই দুরকম মাপকাঠি দিয়ে। অবজেক্টিভ হ্যাজার্ড (প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা) সবার জন্য সমান। তফাৎ করে দেয় সাবজেক্টিভ হ্যাজার্ড। পর্বতারোহীর পর্বতারোহনের তাত্ত্বিক এবং ফলিত শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, মানসিকতা, স্বাস্থ্য, ইত্যাদি, যত পর্বত আরোহণের অনুকূল হবে তত কম হবে তাঁর ‘সাবজেক্টিভ’ প্রতিবন্ধকতা”।   

আট হাজারি শৃঙ্গগুলি জুড়ে মাউন্টেনিয়ারিং ট্যুরিজমের জমজমাট ব্যবসা এবং সেই ব্যবসায় খরিদ্দার হিসেবে ভারতীয়দের বিপুল সংখ্যায় যোগদানের বিষয়ে লিভিং লেজেন্ড রাইনহোল্ড মেসনার ২০১৭ সালে এক ইন্টারভিউতে বলেছেন, “Climbing has totally changed. This year maybe 200 Indians will go to Everest on the piste [a track of firm snow] and since it is possible that Everest is prepared from the base to the summit, many people can go there. But this is not alpinism, this is tourism. People are buying the possibility to go up the piste on Everest. বিগত তিন দশকে বিশ্ব জুড়ে পর্বতারোহণ দর্শনের দৈন্য দেখে ডগ স্কট তো একেবারে রাখঢাক না করেই বলেছেন, “যাদেরই পকেটে টাকা আর মনে ইনস্ট্যান্ট সেলিব্রিটি হবার শখ ছিল তারা তাদের সেই স্বপ্ন কিনতে পেরেছে” ২০০৩ সালে বিবিসি-কে দেওয়া একটি ইন্টারভিউতে স্যার এডমন্ড হিলারি বলেছিলেন, “Having people pay $65000 and then be led up the mountain by a couple of experienced guides isn’t really mountaineering at all”আর এই ২০২০ সালের এপ্রিল মাসেঅ্যাডভেঞ্চার মাউন্টেন’ পত্রিকার এক ইন্টারভিউতে ক্রিস বনিংটন বলেছেন, “What’s happening on Everest? I mean, commercial expeditions on Everest have absolutely nothing to do with climbing whatsoever.”

তবে, বনিংটন-ডগ স্কটরা কী বলছেন এবং পর্বতারোহীদের মধ্যে কীরকম দার্শনিক এবং পরিণত ধ্যানধারণা থাকা উচিত, এসব বিষয়ে কথা বলা আজ এই দেশ, বিশেষ করে এই রাজ্যে ভস্মে ঘি ঢালার সমতুল্য। খবরের কাগজ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে তাকালেই সেকথা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। এদেশে যারা এভারেস্ট, কিংবা সমতুল ঘরানার, অর্থাৎ, ৮০০০ মিটারের কোনও পাহাড়ে ওঠেন তাঁরাই রাতারাতি পূজিত হন। সেই পূজা পর্বতারোহণ-মূর্খ কোনও সাংবাদিকের উচ্ছ্বসিত রিপোর্টেই থেমে থাকে না, খোদ সরকার বাহাদুরও সময় বিশেষে এই দিগ্বিজয়ী বীরদের কখনও সম্মানীয় পদ কখনও সুবর্ণ পদক ইত্যাদিতে ভূষিত করে থাকেন। একবারও ভাবা হয় না যে, এই স্বঘোষিত, দিগ্বিজয়ী অভিযাত্রীরা আসলে শেরপা এবং স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সির অ্যাডভেঞ্চার কেটারিং সার্ভিসের সম্মানীয় ক্রেতা। যুবসমাজকে একবারও ভেবে দেখার সময় দেওয়া হয় না যে, মাউন্টেন ট্যুরিজম এবং মাউন্টেনিয়ারিং— এই দু’টির মধ্যে তফাত আকাশ এবং পাতালের, সোনা এবং সোনার পাথরবাটির। একই চিত্রনাট্য পুনরাবৃত্ত হয় ভারতীয় হিমালয়ে মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবগুলির দ্বারা আয়োজিত ‘অভিযান’-এ। শেরপারা কাজ করেন, বাবুরা বলেন করেছি। বলেন, ফিক্সড রোপে জুমার লাগানো দেখতে পাচ্ছেন তো কী হয়েছে, আসলে আমরা নিজেরাই ক্লাইম্ব করেছি; জুমার তো প্রপঞ্চময় মায়াসত্যি, কম ঝক্কি পোয়াতে হয় শেরপা ভাইদের! এদিকে, এই সমস্ত ‘গাইডেড’ এবং ‘ফুল সার্ভিস’ অভিযান যে আদতে কুণ্ডু ট্রাভেলসের সঙ্গে চারধাম ভ্রমণের হাই-অল্টিচিউড ভারশন, তা আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাই না। এক্সপিডিশন থেকে ফেরা বাংলার বনিংটনরা তার পর থেকে দূর্গাপুজার ফিতে ছাড়া আর কিছু কাটেন না এবং দেখা দেন আগামীকালের পর্বতারোহণের উপদেষ্টা, এমনকী, নীতিনির্ধারক রূপে এতক্ষণে, পাঠক নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পেরেছেন যে, পিউরিস্ট পর্বতারোহীদের একসময়ে দেখা উত্তরণের স্বপ্ন, ঠিক কোন বেনো জলের প্লাবনে বাংলায় দানা বাঁধতে পারেনি! নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, স্বল্প সময়ের জন্য সীমিত মানুষজনের মধ্যে সেই চেতনা এসে থাকলেও, কেন তা সর্বব্যাপী এবং দীর্ঘমেয়াদি হয়নি।

ক্রমশ...

দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্ত  

(দ্বিতীয় পর্বের লিংক)

Illustration courtesy: Freevector 

Comments

Popular posts from this blog

Across The Sahara on a Bicycle

Across The Sahara on a Bicycle Between the things we get And the things we celebrate Flows a desert                            Lest we forget. #SaharaQuartet Background: My Africa My first exposure to the real Africa in 2005 after climbing Kilimanjaro. Scanned from slide. On top of Kilimanjaro in 2005 with a copy of Tathyakendra magazine. Scanned from slide I first visited Africa (Tanzania to be specific) in 2005. I hiked Kilimanjaro and came back home. It was just a tourist thing I did. But in spite of being wrapped up in an itinerary and a travel package of all things touristy; something very curious happened. I got even more inquisitive about Africa. I wanted to go back to Africa. Not as a tourist, but as a drifting wanderer, living an ever curious life. But for that I had to wait a good seven years. In 2011, while I was exploring the barriers of the Nanda Devi Sanctuary in ...

To the Mountains of the Moon: A Journey from Fiction to Facts

In 1937, Bibhutibhushan Bandyopadhyay chronicled the adventures of a Bengali boy named Shankar. This novel was named 'Chander Pahar' (English: 'Mountains of the Moon', as the fiction refers to a range of mountains and not a single standing mountain). 'Chander Pahar' went on to become one of the most loved adventure stories in the Bengali literature. In his lifetime, Bibhutibhushan wrote 16 novels and over 200 short stories. Interestingly, even though most of Bibhutibhushan's works were largely set in rural Bengal; in this particular novel the writer chose the setting of 1909 Africa. Bibhutibhushan Bandyopadhyay (1894-1950) In the story 'Chander Pahar', our protagonist Shankar gets a lucky break to go out from his little riverside village in Bengal to work for the Uganda Railway. Thus begun his sudden and long journey from the mundane to the extraordinary. A roller coaster ride through adventures involving the infamous man eating lions of Tsav...

Straight from a Story Book: Part I

It all started with a story book. In 1937, Bibhuti Bhushan Bandyopadhyay , one of the leading writers of modern Bengali literature penned ' Chander Pahar '. It is a story of a 22 year old young man from rural Bengal who sets out to Africa on an adventure of a lifetime in 1909. (If you have not read the book already you can read the plot summary here: https://en.wikipedia.org/wiki/Chander_Pahar ) Like millions of Bengali readers I had read this adventure story when I was a kid and then as I grew up, as indicated by its publisher (juvenile literature); it became a thing of the past, a childhood fantasy for me.  It is only in recent years, after I climbed Kilimanjaro (2005), I picked up 'Chander Pahar' again. It is then, the book started opening new meanings and fresh directions for me. It is then I began to understand the meaning of the Swedish proverb- 'In a good book the best is between the lines' .  My repeated readings of 'Chander Pah...