বিকাশের অসুখ




বিকাশের অসুখ 

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়

 ২০১৩। সম্ভবত জুন কিংবা জুলাই। তারিখটা সঠিক মনে পড়ছে না এই মুহুর্তে। আসলে হয়ত মনে করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিশ্রমটুকুও করতে রাজি নই আমি আজ। দিন, মাস, কিংবা তারিখে কিই বা আসে যায়? বিশেষত, যখন সেই দিন আমি এবং আমার সঙ্গীরা কেউই মারা যাই নি। বহাল তবিয়তে দিব্যি বেঁচে আছি আজও। মারা গেলে অবশ্য, সেই দিন, মাস, কিংবা বছর; কিছু মানুষের কাছে মন খারাপের বিষয় হয়ে উঠত। কয়েক বছরের জন্য হলেও, হত। শোক সাময়িক, উচ্ছ্বাস তাৎক্ষণিক, এবং আনন্দ চিরন্তন। তবে স্মৃতি সিলেক্টিভ অ্যামনেসিয়ায় ভোগে। পছন্দের জিনিষ ঠিক মনে থাকে। বাকি সব কিছু, কিছু দিনের। তাই ইতিহাস পড়া হয়। শেখা হয় না। এই আমাদের রক্তশূন্য সভ্যতা। প্রতিদিন ঘুম ভাঙে মিথ্যা এবং প্রবঞ্চনায়। চোখ বুজি স্তোকবাক্যে। সভ্যতার গল্পে আজকাল বিশ্বাস হয় না আর।

যাই হোক, সেই বছর উত্তরাখণ্ডে ক্লাউড বার্স্ট হয়েছিল। ‘ক্লাউড বার্স্ট’-ঘন কালো বিদ্যুৎ চমকানো মেঘের মত একটা নাম। বার্স্ট, অর্থাৎ, বিস্ফোরণ। বাংলা ভাষায় কেউ মেঘ ফেটেছে না বললেও, হিন্দিতে ‘বাদল ফাট গয়া’, বলা হয়। যেকোনো বিস্ফোরণের মধ্যেই, তা সে টেররিস্টের হোক, কিংবা প্রকৃতির; একটা চমক থাকে। মানুষকে হতবাক করে দেবার ক্ষমতা থাকে। ক্লাউড বার্স্ট সেরকমই এক জিহাদ, প্রকৃতির মৌলবাদ। তো, সেই বিস্ফোরণের সময়, আমরা কয়েকজন আটকে পড়েছিলাম ত্রিশূল পাহাড়ের ওয়েস্ট ফেসের একেবারে পায়ের তলায়। নেহাতই ঘটনাচক্রে। ‘ওয়েস্ট ফেস’ কথাটা এখন লিখতে গিয়ে মনে হল, আমরা যাকে পাথর কিংবা বরফের দেওয়াল দেখি; সাহেবরা সেখানে মুখ দেখতে পায়। আর মুখ থাকলেই তার একটা পরিচয় থাকে, চরিত্র থাকে। তখন, অচেনা হলেও তার দিকে হাত বাড়িয়ে ‘হ্যালো’ বলা যায়। আমাদের ক্লাইম্বিং যেখানে দুরূহ দেওয়াল দেখে থমকে যায়, ওরা সেখানে মুখের অবয়ব খুঁজে পায়। সম্ভবত, এই প্রাণসন্ধানী মানসিকতাই ওদের ক্লাইম্বিং এর কাজটা সহজ করে দেয়। আমরা হাঁ করে পাঁচিলের নীচে দাঁড়িয়ে থাকি। দড়িদড়া বেঁধে যুদ্ধ জয়ের মহড়া দিই। ওদের আলাপ সখ্যতায় গড়ায়। 

দেওয়ালের মুখ দেখব, এই সঙ্কল্প নিয়েই সেবার কজন গিয়েছিলাম ত্রিশূল। কিন্তু, মেঘ ফাটবে, প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে; এমন সম্ভাবনা দুঃস্বপ্নেও কারো মাথায় আসেনি। বর্ষা বলে কয়ে আসে। মেঘ নোটিস দিয়ে ফাটে না। এই আকস্মিক চরিত্রের জন্যই সে বিস্ফোরণ, দহন নয়। তিনদিন, একটানা বৃষ্টি পড়েছিল। আমরা অবাক হয়েছিলাম এত উচ্চতায় বৃষ্টির ফোঁটার আয়তন দেখে। আমাদের মধ্যে কেউ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল, গ্লোবাল ওয়ার্মিং। বৃষ্টি পড়া বন্ধ হতে না হতেই, বরফ পড়া আরম্ভ। এতদিনে আমাদের সবকটা তাঁবুই অল্পবিস্তর ছিঁড়ে গিয়েছিল। এবার তাজা বরফের ভারে তারা আমাদের গায়ে নুয়ে পড়তে লাগল। খাবার সদ্য শেষ হয়েছিল। কেরোসিন ছিল, তাই স্টোভ জ্বলছিল। ডেকচিতে চাপান বরফ গলছিল। আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল না। তবু, শরীরের ক্ষমতা, একটু একটু করে ফুরিয়ে আসাটা বেশ জানান দিচ্ছিল। মগজের একটা দিক বলছিল, এভাবেই বরফ চাপা পড়ে এবার মারা যাব আমরা সকলে। মগজের অন্য একটা দিক অঙ্ক কষছিল, বাঁচার অঙ্ক। ঘুমিয়ে পড়া, জেগে ওঠা; শরীরের এই দুটো কাজই বেশ দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। ঘুমিয়ে পড়লেই ধড়মড়িয়ে জেগে ওঠা। তাঁবুর গা যতটা সম্ভব বরফমুক্ত রাখা, অকারনে একে অপরকে চেঁচিয়ে ডাকা;এসব চলছিল যান্ত্রিক ভাবে। আমাদেরও মুখ আছে, নাম আছে; সেগুলো মনে থাকাটা অসম্ভব জরুরী হয়ে পড়ছিল। হতাশার পাল্লা একটু একটু করে ভারী হচ্ছিল। মেঘ কাটছিল না। বরফ পড়া থামছিল না। তাঁবু জলে ভাসছিল। আমাদের জ্যাকেট এবং স্লিপিং ব্যাগ, আমাদের শরীরের উষ্ণতা রক্ষার বদলে, শুষে নিচ্ছিল। আমরা অবশ হয়ে আসছিলাম। মৃত্যুকে মেনে নিচ্ছিলাম। চারদিন গড়িয়ে যেদিন পাঁচ, সেদিন চারদিক থেকে অ্যাভালাঞ্চ নামা আরম্ভ হল। আমরা ঘড়ি মিলিয়ে দেখলাম, প্রতি ছ মিনিটে একটা অ্যাভালাঞ্চ। একদম বুক কাঁপানো, হাড় হিম করা। এতদিন হিমবাহের মধ্যে দ্বীপের মত জেগে ওঠা একটা মোরেন দেওয়ালের মাথায় আস্তানা গেড়েছিলাম। গোটা হিমবাহে আমাদের এই ক্যাম্পসাইটকে মনে হয়েছিল সবথেকে নিরাপদ ঠিকানা। সেদিন সকালে সেই ক্যাম্পসাইটই যেন বলল, ভাই, অনেক রক্ষা করলাম তোমাদের। এবার তোমরা অন্য পথ দেখ। ক্যাম্পসাইট কথা বলে না, আমি জানি। নুড়ি পাথর, বড় বোল্ডার, মিছরি দানার মত বরফ; এরা কেউ কথা বলে না। কিন্তু এদের সঙ্গেই গত পাঁচদিন ধরে দিব্যি কথা বলছিলাম আমি। অনেক কথা। জমে থাকা, না বলা, ভুলে যাওয়া সব কথা। সব উজাড় করে ওদের বলছিলাম। আমার অস্তিত্ব ওদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল, আর ওদের ঔদাসিন্য আমার মধ্যে। তাই ক্যাম্পসাইট যখন উচ্ছেদের নোটিস হাতে ধরাল, তখন বললাম, যাব কোথায়? কীভাবে? চলার ইচ্ছেটাই চলে যাচ্ছে ক্রমশ। তুমি বরং একটা গল্প শোন। শুনবে? 

ক্যাম্পসাইট কিছু বলে না। সব শুনতে চায়। হয়ত সত্যিই সব শুনতে পায়। তাই বলে চলি। আমাদের পাড়ায় এক পাগল ছিল। নাম ছিল বিকাশ। অদ্ভুত ছিল তার পাগলামি। সোজা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নিজেই নিজের পিঠে টোকা মারত। যেন পিছন থেকে কেউ তাকে ডাকছে। সঙ্গেসঙ্গেই পিছন ফিরে হাঁটা লাগাত সে। আবার কিছুক্ষণ পর সেই একই কাজ। নিজে হাতে নিজের পিঠে টোকা। নিজেকে পিছন থেকে ডাকা এবং অ্যাবাউট টার্ন। পাগলের আর কোথাও পৌঁছনো হত না। একসময় ওর এই পিছুটানের খেলা আমাদের কাছে একঘেয়ে হয়ে যেত। আমরা অন্যকিছু দেখতাম। ও ক্লান্ত হত না। ঘুরেই যেত। কিছুক্ষণ পর খেয়াল হতেই দেখতাম পাগল আর নেই। অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমরা অবাক হয়ে যেতাম। ওর তো একই রাস্তায় ঘুরপাক খেয়ে মরার কথা ছিল! তাহলে ব্যাটা গেল কোথায়? আগে গেল? না পিছনে? ও কি এক পা এগোলে, দু পা পিছোয়? নাকি, উল্টোটা? ও কি সরলরেখায় হিসেব করে পা ফেলে? নাকি, ধীরে ধীরে বৃত্তের পরিধি ছোট করে আনে। তারপর এক নির্দিস্ট বিন্দুতে পৌঁছে হুস করে ভ্যানিস হয়ে যায়? ও কি মানুষ? নাকি, অন্য কোন ডাইমেনসন থেকে ভুল করে এসে আটকে পড়েছে বেলুড় বাজারে। সেই পাগল বিকাশকে অবশ্য দেখতে পাইনা আজকাল। সম্ভবত সে মারা গেছে কোন ফুটপাথে কুঁকড়ে শুয়ে। কিংবা, অন্য ডাইমেনসন থেকে ওর বন্ধুরা এসে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। এখন হয়ত ও বেশ ভাল আছে। আমি বলেই চলি। ক্যাম্পসাইট হাঁ করে শোনে। 

পাগলের গল্প কেন শোনালাম? আসলে আমার তখন মনে হচ্ছিল, আমরা সবাই পাগল। অবিকল সেই বিকাশের মত। আমাদের সভ্যতার মস্তিষ্ক বিকৃতি বিস্তর। তা না হলে, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর; বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া প্রকৃতির মৌলবাদ উপেক্ষা করে থাকি কী করে? সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম, অদ্বৈত বেদান্ত এবং ঘুঁটে; সব সমান এই মৌলবাদের চোখে। সবই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আমরা কেন বুঝেও বুঝতে চাই না, সভ্যতার লক্ষ সমস্যার থেকে বড় বিষয়, প্রকৃতি। বারবার সে আমাদের সাবধান করে দেয়। আমরা হায় হায় করে উঠি। কখনও সুনামি, কখনও ভূমিকম্প, কখনও ক্লাউড বার্স্ট। কখনও নিকোবর, কখনও পাকিস্তান, কখনও উত্তরাখণ্ড। তবু বিস্ফোরণের আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই আমরা ফিরে যাই পটল কুমার কিংবা আইপিএল-এ। নিজের পিঠে নিজেই টোকা মারি। আবার পিছন ফিরে হাঁটি। আমরা পাগল নই? 

ছ নম্বর দিনে মেঘ কেটে যায়। একটুকরো নীল দেখা দেয়। আমরা নিঃশব্দে তাঁবু গুটিয়ে নামা শুরু করি। প্রকৃতির আরও এক হুঁশিয়ারির সাক্ষী আমরা। বার্তা পৌঁছে দিতে হবে বাকি বন্ধুদের কাছে। জানি কেউই শুনবে না আমাদের কথা। তবে হয়ত, পঞ্চাশ কিংবা একশো বছর পর কারো টনক নড়বে। তখন হয়ত অনেক দেরী হয়ে যাবে। বেলুড় বাজারের বিকাশ পাগলের মতই আমরাও ভ্যানিস হয়ে যাব। অন্য কোন ডাইমেনসনে ফিরে যাবার পথ আমাদের কোনদিনই ছিল না। আজও নেই। তবু সেই প্রাণ নিয়ে কোনমতে বেঁচে ফেরার মুহুর্তে আরও গভীর ভাবে ভালো লাগে ক্যাম্পসাইটকে। নিষ্প্রাণ হিমবাহকে বড় দয়ালু মনে হয়। মনে হয়, এই প্রকৃতি ঠিক আমার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের মত। বার্ধক্য, জরা পঙ্গুপ্রায় করেছে। তবু আমায় গভীর ভালবেসে তাঁরা বেঁচে আছেন। আর আমি ভাবছি, আগামীকালও ঘুম থেকে উঠে বাবাকে দেখব। একসঙ্গে চা খাব। মা বলবে, আজ আর কোথাও বেরোস না। বড্ড মেঘ করেছে।

সমাপ্ত 

লেখকের মন্তব্যঃ লেখাটি ২০১৬ সালে 'যারা পরিযায়ী' পত্রিকার পূজা সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল । লেখার সময় অমিতাভ ঘোষের 'দি গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট' আমাকে প্রভাবিত করেছিল।  

Comments

Popular posts from this blog

Across The Sahara on a Bicycle

To the Mountains of the Moon: A Journey from Fiction to Facts

Straight from a Story Book: Part I