Friday, June 11, 2021

লকডাউন স্বগতোক্তি ৪ - স্টেলমেট


দাবা খেলাটা কোনোদিনই খুব ভাল খেলতে পারতাম না। বুদ্ধিমাণ, বিচক্ষণ, ধৈর্যশীল, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষের মত সুচতুর কৌশলী পদক্ষেপ ধারাবাহিকভাবে করে যাওয়া, আর যার হোক এ অধমের কম্মো নয়। এই সত্য অনেক ছোটবেলাতেই  হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। 

লকডাউনে সেই সত্য আবার মনে করিয়ে দিল কম্পিউটার। স্টকফিশ লেভেল থ্রি-র সঙ্গে হেবি ফাইট করেও শেষমেশ সেই স্টেলমেট।  বিপক্ষকে ক্ষমতাশূণ্য করে দিয়েও জেতা হল না। 

অনেকটাই ঠিক জীবনের মত। 

আচ্ছা স্টেলমেটই যদি সারসত্য তাহলে খেলছি কেন এই খেলা?  একদিন ঠিক চেকমেট হবে, এই আশায়? নাকি, জীবনের শেষে স্টেলমেট অনিবার্য জেনেও খেলতে হয়? 



 

Monday, June 7, 2021

পর্বতারোহণঃ একটি ছিন্নডানা স্বপ্ন - দ্বিতীয় পর্ব

পর্বতারোহণঃ একটি ছিন্নডানা স্বপ্ন - দ্বিতীয় পর্ব 

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায় 

(লেখকের মন্তব্যঃ এই লেখাটি দেশ পত্রিকায় ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। সম্পাদকের অনুমতি নিয়ে এবার নিজের ব্লগে দুটি পর্বে প্রকাশ করলাম। এটি  দ্বিতীয় পর্ব। কৃতজ্ঞতা এবিপি প্রাইভেট লিমিটেড। ) প্রথম পর্বের লিংক



বিশ্বের প্রেক্ষাপটে পর্বতারোহণের সেই প্রতীক্ষিত উত্তরণের অধ্যায় শেষ পর্যন্ত না আসার কারণটা অবশ্য বাংলা কিংবা ভারতের মাটিতে বেনো জল ঢোকার মতো সরল নয়। বিষয়টি যেহেতু অনেকটাই ইতিহাসনির্ভর তাই এডওয়ার্ড হোয়াইম্পার এবং ম্যাটারহর্ন পাহাড়ের প্রসঙ্গ আসা অবশ্যম্ভাবী ১৮৬৫ সালে হোয়াইম্পারের নেতৃত্বে ম্যাটারহর্ন শিখর আরোহণকেই ইতিহাসকাররা মোটামুটি ভাবে ইওরোপিয়ান অ্যাল্পিনিজম তথা পর্বতারোহণের জন্মলগ্ন হিসেবে ধরে থাকেন। সেই আরোহণের পর এডওয়ার্ড হোয়াইম্পার লিখেছিলেন, “পৃথিবী আমাদের পদতলে ছিল এবং ম্যাটারহর্নকে আমরা জয় করে ফেলেছিলাম” আজকাল বেশ কিছু পর্বতারোহী বন্ধু (তাদের মধ্যে ভারতীয় প্রায় নেই বললেই চলে) অবশ্য বলে থাকেন, তাঁরা আর সামিটে দাঁড়িয়ে পতাকা ওড়ানোর ধার ধারেন না। তাঁদের কাছে আরোহণের বিশুদ্ধতাটাই মোক্ষ। ‘কী ক্লাইম্ব করছির থেকে কী ভাবে ক্লাইম্ব করছি’- এটাই তাঁদের আনন্দ এবং প্রাপ্তির মাপকাঠি এবং মাইলফলক। তাছাড়াও, তাঁরা এমন কিছু বলতে বা করতে চান না যাতে তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত অ্যাডভেঞ্চার ‘মানুষ প্রকৃতিকে জয় করল’ গোছের এক মুখোশ পরে জনসমক্ষে এসে দাঁড়ায়তাঁরা মনে করেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে বিংশ শতাব্দী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অভিযাত্রীদের ভূরিভূরি ‘তথাকথিত’ বিজয়গাথা সাধারণভাবে প্রকৃতি এবং বিশেষভাবে স্থান-কাল-পাত্রের প্রতি এক সীমাহীন অবজ্ঞার প্রতীক। কারণ, বিজিত পাহাড়ের প্রাচীন, স্থানীয় নাম বদল করেই এইসব অভিযাত্রীরা ক্ষান্ত হননি, যে-মালবাহক এবং স্থানীয় গাইডের হাত ধরে তাঁরা তাঁদের অভীষ্টের কাছে পৌঁছেছিলেন, তাদের অবদান, তাদের গল্প, তাদের সংগ্রামের কথা একরকম অদৃশ্যই রেখেছেন সংশ্লিষ্ট অভিযানের বিবরণে এবং সাহিত্যে এ তো নেহাত আনমনে ভুলে যাওয়া নয়, বরং জাত্যাভিমানে মদমত্ত এক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিসন্ধি। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, হিমালয় জুড়ে এরিক শিপটন এবং বিল টিলম্যানের দুর্দান্ত সব কীর্তি তো আজ হিমালয়সাহিত্যের পাঠক মাত্রেই জানেন, কিন্তু যে তিনজন শেরপা ছাড়া অসম্ভব ছিল তাঁদের অভিযান সফল হওয়া, সেই পাসাং, কুসাং এবং আং থারকের কথা তাঁরা তো বিশদে কখনই কোথাও লেখেননি! এরকম উদাহরণ বিস্তর রয়েছে, তবে আপাতত এই একটিই যথেষ্ট

আজ আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি, যখন সময়ের সরণি বেয়ে মানবজাতির প্রতিটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত এবং ফলস্বরূপ বদলে যাওয়া জীবনযাত্রার অভিমুখ আমাদের নতুন করে, গভীর ভাবে ভাবতে এবং পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করছে। পর্বতাভিযান যেহেতু কোনও ইতিহাসবহির্ভূত ঘটনা নয়, তাই বিশ্লেষণ এবং পুনর্মূল্যায়নের জরুরি তালিকায় সেটিও পড়ে। বিশ্বের কিছু শিক্ষিত, সমাজসচেতন পর্বতারোহীর কাছে মাউন্টেনিয়ারিং আর কেবল ‘পাহাড়-পাহাড় খেলা’ নয়। যে-অভিযানের মধ্যে পরিবেশের প্রতি সচেতন দায়িত্ববোধ, সামাজিক মূল্যবোধ, মানবিক মমত্ব এবং শিক্ষার অবকাশ নেই, সে অভিযান ভ্রান্ত, সে অ্যাডভেঞ্চার পথভ্রষ্ট এবং অপ্রয়োজনীয়। তাঁদের মতে, একটা আরোহণের বিচার হওয়া উচিত পরিবেশের ওপর সেই অভিযানের প্রভাব, মালবাহকদের শ্রম, শেরপাদের করা ফিক্সড রোপ এবং সেই অভিযান থেকে কোনও সুদূরপ্রসারী ভাল কাজ কিংবা শিক্ষার সূত্রপাতের সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে। বিগত শতাব্দীর কলোনিয়াল ঘরানার পর্বতাভিযান, যা আসলে ঔপনিবেশিকদের সাম্রাজ্যবিস্তার ষড়যন্ত্রের অন্যতম একটি অস্ত্র ছিল, তাকে আজকের দিনেও কেন আমরা খোলা ছাড়পত্র দেব কেবলই গুণকীর্তনে? শিক্ষা নিশ্চয়ই নেব সেই সব অভিযান থেকে, তবে প্রশ্নাতীত কেন থাকবে তাঁদের উদ্দেশ্য এবং কাজকর্ম? এমন অনেক কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরে, পাশ্চাত্যের পর্বতারোহণ চর্চায় ইদানীংকালে আলোড়ন তুলেছেন পর্বতারোহণ স্কলার অমৃতা ধর। অমৃতার যুক্তিগুলি গবেষণালব্ধ, ফলে অকাট্য। তাই কেউ-কেউ পাশ কাটিয়ে গেলেও, মূলত সাদাচামড়া অধ্যুষিত বিশ্ব পর্বতারোহণের দুনিয়ার বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কাজটি অমৃতা করে দিয়েছেন

এ প্রসঙ্গে তরুণ ব্রিটিশ চিত্রকর রিচার্ড টি ওয়াকারের ২০১৫ সালের কাজ ‘দি ফলিবিলিটি অফ ইনটেন্ট’ উল্লেখযোগ্য। ওয়াকার এই কাজটি করেছেন আর্কাইভাল পিগমেন্ট প্রিন্টে এবং মূল উপাদান হিসেবে বেছে নিয়েছেন হোয়াইম্পারের ১৮৭১ সালের বই ‘স্ক্র্যাম্বলস অ্যামংস্ট দি আল্পস’-এ ব্যবহৃত ম্যাটারহর্নের একটি সাদাকালো ছবি। ওয়াকার বইয়ের ছবিটিকে কেটে বসিয়েছেন তাঁর ক্যানভাসের উপত্যকায়, আর তারপর তার শীর্ষবিন্দুটিকে ঢেকে দিয়েছেন এক গাঢ় লাল ভাসমান বৃত্তে ম্যাটারহর্ন পাহাড়ের ভূগোল বদলে দিয়ে শিল্পী চেয়েছেন পর্বতারোহণের চিরাচরিত ঔপনিবেশিক প্রবণতা এবং আকাঙ্ক্ষাগুলিকে অস্বস্তিতে ফেলে দিতে। দর্শক বুঝতে পারছেন লাল বৃত্তটি ম্যাটারহর্নের শিখরকে আড়াল করে রেখেছে, কিন্তু দেখতে পাচ্ছেন না। শিল্পী বলতে চেয়েছেন, যুদ্ধজয়ের কায়দায়, যে-কোনও মূল্যে পাহাড়ের চুড়ায় দাঁড়িয়ে বিজয় ঘোষণা করতে হবে— পর্বতারোহীদের মধ্যে চলতে থাকা এই প্রবণতাটিই একটি গড্ডলিকাপ্রবাহ এবং এও এক ধরনের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারতাঁর মতে, শিখর দেখতে পেলেই তার মাথায় যেন তেন প্রকারেণ উঠে পড়ার ট্র্যাডিশন আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হলেও ঐতিহাসিকভাবে তা ভ্রমশীল। শিখর আড়াল করে থাকা ওয়াকারের লাল বৃত্ত তাই অনেকটাই রহস্যের অবকাশ, নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের সুযোগ এবং প্রতিরোধের চিহ্ন। তাহলে কি বিশ্বের পর্বতারোহণের সেই অধ্যায়, যার আসার কথা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসতে পারেনি, তার অসাফল্য এইরকম এক ভ্রান্ত, অন্তঃসারশূন্য উত্তরাধিকারের ভার নীরবে বয়ে চলারই পরিণাম? নাকি, চিন্তাহীন অপরিণামদর্শিতা ছাড়াও অন্য কোনও বাড়তি ফ্যাক্টর এখানে কাজ করেছে?

 

অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের আস্ফালনে আমাজনের কায়াপো, সিকিমের লেপচা, কেনিয়ার মাসাই, চিনের ঈ, কালাহারির বুশম্যান, এবং গ্রিনল্যান্ডের ইনুইট আজ নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি ভুলতে চলেছে। ‘কর্পোরেট গ্রিড ওভার হিউম্যান নিড’-এর সন্ত্রাসে প্রকৃতি আজ বিধ্বস্ত, জীববৈচিত্র সন্ত্রস্ত ইউনিফর্মিটির সঙ্গে সম্মুখসমরে ডাইভার্সিটি পরাস্ত। মধ্যমেধার নবজাগরণ এবং তার গণ-উদ্‌যাপনের ফলে আজ ঠিক একই ভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি নাভিশ্বাস উঠেছে পর্বতারোহণের দর্শনেরম্যালোরির ‘বিকজ় ইট ইস দেয়ার’ কিংবা চেস্টারটনের ‘থিং’ (যেটি আসলে কোন একটি বিষয় সম্বন্ধে মানুষের ধ্যানধারণা এবং সেই ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে সেই মানুষটির আচার-ব্যবহারের একটি অভিজ্ঞতালব্ধ আলোচনা) — সবকিছুরই প্রকৃত অর্থ হারিয়ে গেছে। পর্বতারোহণ দুনিয়ার এই সামুহিক অবক্ষয়ের অভিমুখ দেখেই ২০০২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্লাইম্বিং অ্যান্ড মাউন্টেনিয়ারিং ফেডারেশন (Union Internationale des Associations d'Alpinisme- UIAA) এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করেন যা আজদি টিরল ডিক্লেয়ারেশননামে পরিচিত টিরল ঘোষণায় একটা কথা পরিষ্কার ভাবেই বলা হয়েছে, বিপদ এবং অনিশ্চয়তা ব্যতীত ক্লাইম্বিং তার প্রকৃত পরিচয়, তার সংজ্ঞায়িত উপাদান হারায়— এবং তা হল অ্যাডভেঞ্চার Without danger and uncertainty climbing loses its defining element-adventure”

এদিকে বিশ্বের পর্বতারোহণ ম্যাপে যুক্ত হয়েছে নতুন এক শ্রেণি এঁরা নিজেদের মাউন্টেনিয়ার কিংবা অ্যাল্পিনিস্ট নয়, পরিচয় দিচ্ছেন মাউন্টেন অ্যাথলিটহিসেবে একের পর এক শিখর জুড়ে, তা আল্পসই হোক কিংবা হিমালয়, গত দশ বছরে আমরা যে স্পিড রেকর্ড ভাঙার প্রতিযোগিতা দেখছি, তাতে একটাই প্রশ্ন বারবার ফিরে আসছে। পর্বতারোহণ কি অলিম্পিক গেমসের একটা ইভেন্টে পরিণত হয়েছে? ২০১৩ সালে, এভারেস্টের লোৎসে ফেসে উয়েলি স্টেক-সিমোনে মোরোদের সঙ্গে শেরপাদের হাতাহাতি-রেষারেষি পৃথিবীর সামনে এক চরম অস্বস্তিকর চিত্র তুলে ধরেছে। ঘটনাটি, এভারেস্টে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিবছর রুজিরুটির তাগিদে ফিরে আসা শেরপাদের সংগ্রামের সঙ্গে এ যুগের মাউন্টেন অ্যাথলিটদের গ্যালারি শট নেবার প্রবণতার একটি প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ। ফি বছর আরও বিচিত্র, আরও কঠিন, আরও দ্রুত গতির কিছু চমক জাগানো ক্লাইম্ব করাকে উয়েলি স্টেক বলতেন তাঁর ‘বিজনেস’। এভারেস্টের সেই তিক্ত ঘটনার পর ‘দি নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে উয়েলি স্টেক বলেছিলেন, “To make business, you need stories. To create stories, you need to come up with projects—bigger and bigger ones with each passing years—and then you need to succeed at them” ২০১৭ সালে নুপৎসে শিখরে যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় উয়েলি স্টেক শেষ পর্যন্ত মারা গেলেন তার জন্যও সেইবিগার অ্যান্ড বিগারপ্রজেক্ট করার দর্শন দায়ী বইকি আজ ইন্টারনেট জুড়ে প্রতিনিয়ত এক-একজন স্পনসরড মাউন্টেন অ্যাথলিটেরবিগার অ্যান্ড বিগার-এর পিছনে ছোটা দেখে তাই কখনই বিখ্যাত ইতালীয় অ্যাল্পিনিস্ট ওয়াল্টার বোনাত্তির সেই উক্তি মনে পড়ে না: “What is there, beyond the mountain, if not the man?” একইভাবে, ইদানীংকালে হিমালয়- কারাকোরামে অভিযানগুলোর খবর দেখলে বা শুনলে বোঝা যায়, প্রচার পাবার মরিয়া প্রচেষ্টায় দলগুলি যা-খুশি তাই করতে প্রস্তুত। প্রাথমিক ভাবে স্পনসর জোগাড় এবং তারপর সেই স্পনসরকে টিকিয়ে রাখার তাড়নায় আজকের একশ্রেণির পর্বতারোহীরা মোটা দাগের চিত্রনাট্য শুধু নয়, প্রাণের বাজি রাখতেও রাজি। আট হাজার মিটারের পাহাড় হোক কিংবা আল্পসের কোনও নর্থ ফেস, খবরে থাকার জন্য এই পর্বতারোহীরা যে-কোনও মাদারি-কা-খেল দেখাতে প্রস্তুত। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন একটাই উঠে আসে, এঁদের পর্বতারোহণের মুখ্য উদ্দেশ্য তাহলে আজ কোন পর্যায়ে নেমে এসেছে? ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি? রাতারাতি সেলিব্রিটি হবার প্রলোভন? উয়েলি স্টেকের ‘বিগার অ্যান্ড বিগার’? নাকি, বিশ্বের কাছে নতুন কিছু প্রমাণ করে দেখানোর তাগিদ?

তবে বিশ্বের প্রেক্ষাপটে সেই স্বপ্নের প্রত্যাবর্তনের আশার পাল্লা ভারী কারণ, বাংলা তথা ভারতে যখন পর্বতারোহণ জগতের কলকাঠি নাড়েন অপদার্থের দল, ওদের পর্বতারোহণ জগতের মূলস্রোতে এখনও বিচরণ করেন পিউরিস্ট, ক্লাসিক ঘরানার অভিযাত্রীরা জেরলিন্ডে কাল্টেনব্রুনারের সঙ্গে কে-টু আরোহণ করা পোলিশ পর্বতারোহী দারিউস জালুস্কি ২০১৯ সালে আমাকে বলেছিলেন, “পাহাড় আমার স্টেডিয়াম নয়, পাহাড় আমার থিয়েটার দারিউসের কথায় আমার মনে পড়েছিল, ১৯৮৫ সালে গাশেরব্রুম-৪ শৃঙ্গের পশ্চিম দেওয়ালে আটকে পড়া আর এক পোলিশ পর্বতারোহী ভয়টেক কুর্তিকার কথা কুর্তিকা এবং রবার্ট শাউয়ার সেবার ওয়েস্ট ফেস ক্লাইম্ব করে ফেলেছিলেন, কিন্তু শিখর তখনও দূরে ছিল কুর্তিকা বুঝতে পেরেছিলেন, আর এগোলে মৃত্যু নিশ্চিত তাই দু’জনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নেমে আসার সামিটে না গেলেও বিশ্বের পর্বতারোহী মহল তাঁদের এই ক্লাইম্বকে অসম্পূর্ণ বলেননি সেই প্রসঙ্গে কুর্তিকা বলেছিলেন, “এর থেকে বোঝা যায়, অ্যাল্পিনিজম আসলে স্পোর্টনয়, এটি একটি আর্ট Only in art does a missing link contribute to the meaning of a piece” অসম্ভবের সীমারেখায় ছবি আঁকা এই ক্লাইম্বিং রুট দেখে কেউ কেউ একে শতাব্দীর সেরা ক্লাইম্বতকমা দিতে চেয়েছিলেন তার জবাবে কুর্তিকা বলেছিলেন, “কোনও একটি বিশেষ কবিতাকে কি কখনও শতাব্দীর সেরা কবিতা বলা যায়?” তাই, কুর্তিকা এবং দারিউসের দেখানো দর্শনের ওপর ভরসা রেখে, আজ মনে হয় আবার নতুন করে এক সরল এবং নান্দনিক স্বপ্ন দেখা শুরু করা যায়। ভেবে নেওয়াই যায়, জয়পতাকা ওড়ানোর অভিপ্রায়ে নয়, আবার একদিন বাংলায় সেদিন আসবে যেদিন অভিযান হবে নির্ভেজাল আনন্দের খোঁজে। নিজেদের ক্ষমতা, শৈলী এবং অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে প্রথমে ছোট ছোট শৃঙ্গ দিয়ে হাত পাকাবেন তাঁরা। তারপর একদিন কেবল গুটিকয় বন্ধু মিলে, পেল্লায় স্যাক কাঁধে তুলে নিয়ে, অপেক্ষাকৃত উঁচু পাহাড়ে, কঠিনতর ক্লাইম্বিং চ্যালেঞ্জের সন্ধানে পাড়ি দেবেন ঠিক যেমন ভাবে একদিন ফিনিক্সের মতো, পোলিশ অভিযাত্রীরা তাঁদের যাত্রা শুরু করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের বুক থেকে। পর্বতারোহণ সেদিন হবে আত্মিক উত্তরণের সোপান, বেঁচে থাকার উদযাপন— আ সেলিব্রেশন অফ লাইফ ইটসেলফ।

 

সমাপ্ত

Illustration courtesy: Freevector

পর্বতারোহণঃ একটি ছিন্নডানা স্বপ্ন- প্রথম পর্ব

পর্বতারোহণঃ একটি ছিন্নডানা স্বপ্ন -(প্রথম পর্ব)

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়

(লেখকের মন্তব্যঃ এই লেখাটি দেশ পত্রিকায় ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। সম্পাদকের অনুমতি নিয়ে এবার নিজের ব্লগে দুটি পর্বে প্রকাশ করলাম। এটি প্রথম পর্ব। কৃতজ্ঞতা এবিপি প্রাইভেট লিমিটেড। ) 




পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে, ইওরোপ-আমেরিকার পাহাড়িয়া আড্ডায়, পোড় খাওয়া এবং পোড় খেতে উদ্‌গ্রীব পর্বতারোহীদের মুখে মুখে একটা আলোচনা খুবই শোনা যেত আল্পসের শামোনি কিংবা ওয়েলসের প্লাস--ব্রেনিন, মাল্টি-পিচ কিংবা কোনও বোল্ডারিং সমস্যার শেষে, গ্রামের শুঁড়িখানায় বিয়ারের গ্লাসে ফেনার মতোই উপচে পড়ত একটা সম্ভাবনার কথা শোনা যেত, হিমালয় এবং কারাকোরামের উচ্চতম সবক’টি পাহাড় আরোহণ হয়ে গেলেই, পর্বতারোহণের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হবে বলা হত, তখন আর হাল্লা-চলেছে-যুদ্ধের কায়দায় বিশাল আকার-প্রকারের অভিযান সংগঠিত হবে না তখন কেবল গুটিকয় বন্ধু, পেল্লায় স্যাক কাঁধে তুলে নিয়ে, অপেক্ষাকৃত ছোট পাহাড়ে, কঠিনতর ক্লাইম্বিং চ্যালেঞ্জের সন্ধানে পাড়ি দেবে। স্নোডনিয়া, লেক ডিস্ট্রিক্ট, কানাডিয়ান রকিস, সিয়েরা ক্যাসকেডস থেকে জারম্যাট-গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের পাথর-বরফে ঘষা খেয়ে প্রতিনিয়ত উদ্ভাবিত হয়ে চলা নতুন ক্লাইম্বিং পদ্ধতি, শৈলী এবং সরঞ্জামের যথার্থ প্রয়োগের ক্যানভাস খুঁজে বেড়াবে এই নতুন প্রজন্মের পর্বতারোহীরা, হিমালয় এবং কারাকোরাম জুড়ে। বলা হত, আফটার অল, ক্লাইম্বিং ইস অলসো আ ফর্ম অফ আর্ট এবং আর পাঁচটা আর্ট ফর্মের মতোই পর্বতারোহণও বিবর্তিত, উন্নত, আধুনিক হবে এবং মানুষকে ভাবতে বাধ্য করবে

১৯৫৬ সালে, আজকের গিলগিট বাল্টিস্তান এবং শিনচিয়াং সীমান্তে মুজতাঘ টাওয়ারে ব্রিটিশ অভিযানের সাফল্য দেখিয়ে দিয়েছিল কারাকোরাম বা হিমালয়ের মতো প্রত্যন্ত পর্বতমালায়, ৭০০০ মিটারের শৃঙ্গে, কলোনিয়াল ঘরানার বাহুল্য বর্জন করেও অতি উচ্চ মানের টেকনিকাল ক্লাইম্বিং কী ভাবে করা যায় ৭ জুলাই, ইয়ান ম্যাকনট-ডেভিস এবং জো ব্রাউন মুজতাঘ টাওয়ারের পশ্চিম শিখর আরোহণ করেছিলেন এবং ঠিক তার পরদিন, টম প্যাটি এবং জন হারটগ সেই একই রুটে মুজতাঘ টাওয়ারের পশ্চিম এবং পূর্ব সামিট ট্র্যাভার্স করেছিলেন। প্রখ্যাত পর্বতারোহী ট্রেভর ব্রাহাম ‘দি অ্যাল্পাইন জার্নালে’ লিখেছিলেন, “১৯৭০ সালের অন্নপূর্ণা সাউথ ফেস ক্লাইম্বের থেকেও, সময় এবং পরিস্থিতির বিচারে ১৯৫৬ সালের এই ক্লাইম্ব প্রকৃত অর্থেই পথপ্রদর্শক ছিল” তার ঠিক পরের বছরই আরও এক নতুন ধরনের হাই-অল্টিচিউড ক্লাইম্বিং পদ্ধতি দেখা দিয়েছিল কারাকোরামে ৮০৪৭ মিটারের ব্রড পিকে। অস্ট্রিয়ার এই দলে ছিলেন মাত্র চারজন ক্লাইম্বার। কোনও শেরপা, হাই-অল্টিচিউড পোর্টার ইত্যাদি ছাড়াই ব্রড পিক আরোহণ করেও তাঁরা থেমে থাকেননিদল এবার দু’ভাগে ভাগ করে নিয়ে তাঁরা দু’টি ভিন্ন শৃঙ্গে আরোহণ শুরু করেছিলেন। দু’জন (মার্কাস শ্মুক এবং ফ্রিৎজ উইন্টারস্টেলার) আরোহণ করেছিলেন ৭৪২০ মিটারের এক অনামা শৃঙ্গ, আর অন্য দু’জন চেষ্টা করেছিলেন চোগোলিসা (৭৬৫৪ মিটার) ক্লাইম্ব করারএই দ্বিতীয় দলে ছিলেন হারমান বুল এবং কুর্ট ডিয়েমবার্গার। দুর্ভাগ্যক্রমে এই চোগোলিসাই ছিল প্রবাদপ্রতিম হারমান বুলের শেষ ক্লাইম্ব। কিন্তু, শিখর গিরিশিরার কর্নিস ভেঙে বুলের মতো পর্বতারোহীর চিরতরে হারিয়ে যাবার পাশাপাশি যে-স্বপ্নটা বিশ্বের পর্বতারোহীদের মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল, তা হল— কয়েকজন বন্ধু মিলে হিমালয়-কারাকোরামের মতো বৃহত্তর পর্বতমালায় গিয়ে তাহলে কেবল একাধিক টেকনিকাল শিখরই নয়, আট হাজারি শৃঙ্গও ‘হারমান বুল স্টাইলে’ আরোহণ করা সম্ভব। এই চালচিত্র থেকে জাম্প-কাট করে যদি চলে আসি ১৯৮১ সালে, নন্দাদেবী স্যাংচুয়ারির দক্ষিণ দেওয়ালে, তাহলে দেখতে পাব বিদ্যুৎ সরকারের নেতৃত্বে মাইকতোলি সহ মোট তিনটি বাইশ হাজার ফুটের শিখর আরোহণ করছেন গৌতম দত্ত এবং অমূল্য রায়। করছেন কোনও শেরপা কিংবা হাই-অল্টিচিউড পোর্টারের সাহায্য ছাড়াই। রামধনুর দুই প্রান্তের মতোই কারাকোরামে হারমান বুলের জন্ম দেওয়া স্বপ্নের ক্লাইম্বিং ঘরানা এবং দর্শন মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছিল বাংলার এই পর্বতারোহীদের আইস-অ্যাক্সে ভর করে।

ইয়োরোপের আরও এক দশক পরে, অর্থাৎ, ষাটের দশকের শেষ দিকে এই বহুলচর্চিত সম্ভাবনার রশ্মি আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গেও এসে পৌঁছেছিল। ভারতের মধ্যে বাংলাই যে এই বিষয়ে অগ্রণী ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বইয়ের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক যে অনেক পুরনো! রামানন্দ ভারতী, সুকুমার বসু, শঙ্কু মহারাজ তো ছিলেনই, তবে সবার ওপরে এক নির্ভরযোগ্য ছাতার মতো ছিলেন উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর সাগ্রহ পথপ্রদর্শনেই গড়ে উঠেছিল পশ্চিমবাংলার পর্বতারোহণে পথিকৃৎ একটি ক্লাব, হিমালয়ান ইনস্টিটিউট (পরে অ্যাসোসিয়েশন)। বিশ্বের প্রায় প্রত্যেক স্বনামধন্য পর্বতারোহীর জীবনে অনুঘটকের ভূমিকায় আছে পর্বতারোহণ-সাহিত্য। অ্যালবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিফেন স্লেমন ‘অ্যাল্পিনিস্ট’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে সম্প্রতি লিখেছেন, “Most climbers aren’t born to the mountains: they read their way into them” বাংলার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেরকমই হয়েছিল হিমালয়ের কোলে কিংবা নিদেনপক্ষে পাদদেশে না জন্মেও, পর্বতারোহণ-সাহিত্যের হাত ধরেই দুনিয়া জুড়ে ক্লাইম্বিং-এর হালহকিকত বাঙালি অনুধাবন করেছিল ভারতের অন্য প্রদেশগুলির আগেই।

জো ব্রাউন আর ইয়ান ম্যাকনট-ডেভিস কিংবা জো টাস্কার আর পিটার বোর্ডম্যানের নাড়ির খবর বাংলার কিছু ক্লাইম্বার তখনই রাখতেন। ফলে, সবরকম প্রাদেশিকতার ঊর্ধ্বে উঠে আজ একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সাহিত্যের আলোকে অনুপ্রাণিত হয়েই সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশক জুড়ে বাংলায় এসেছিল হিমালয়ের ক্যানভাসে অ্যাল্পাইন স্টাইলে পর্বত আরোহণের আর্ট এবং শেরপাদের কাঁধে ভর না করে নিজেদের ক্ষমতায় শিখর আরোহণের প্রচেষ্টা। সম্ভাবনাময় নতুন সেই অধ্যায়কে দীর্ঘজীবী করার রোমান্স থেকে বাঙালি বাদ যায়নি। বিদ্যুৎ সরকার, গৌতম দত্ত, প্রদীপ দাস, বনভূষণ নায়ক, অমূল্য রায়ের মতো আরও বেশ কিছু নাম দূরের তারার মতো চিকচিক করে উঠেছিল। তিরিশের দশকে হিমালয়-কারাকোরাম-আফ্রিকা দাপানো প্রবাদপ্রতিম জুটি এরিক শিপটন এবং বিল টিলম্যানের মতো, আটা ভাজা, ছাতু আর পাটালিগুড়ে হিমালয় ডিঙোনোর শক্তি, ’৭০-’৮০র দশকের এই একঝাঁক বাঙালি ক্লাইম্বাররাও আপন করে নিয়েছিলেন। অথচ আজ, এই ২০২০ খ্রিস্টাব্দে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতেই হয় যে, পর্বতারোহণের আধুনিক ধারায় পা রেখে নতুন অধ্যায়ের সূচনা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নিনা, কেবল, এই বাংলা তথা ভারতবর্ষেই যে পর্বতারোহণের সেই প্রতিশ্রুত, যুগান্তকারী অধ্যায় আসেনি তা নয়; গোটা বিশ্বেই আসেনি। তার অন্যতম কারণ হল, বিগত তিন দশকে এই জমিতে বেনো জল ঢুকেছে বাঁধভাঙা বন্যার মতো। ফলে, পর্বতারোহণ জগতে নবাগতের পদার্পণ এবং যথাসময়ে উত্তরণের মুখ্য দার্শনিক শর্ত এবং তার উদ্দেশ্যের বিশুদ্ধতা বিষিয়ে গেছে। স্যার এডমন্ড হিলারি, ক্রিস বনিংটন, ডগ স্কট, ট্রেভর ব্রাহাম, জো ব্রাউন, ইভন শুইনা, রাইনহোল্ড মেসনার থেকে স্টিফেন ভেনাবলস— এঁরা সকলেই সহমত এই একটা ব্যাপারে।

নব্বইয়ের দশকে রব হল-গ্যারি বলের হাত ধরে সেই যে মাউন্ট এভারেস্টের গায়ে ‘ফর সেল’ তকমা লেগেছিল আজ তা এক অতিমারির রূপ নিয়েছে। প্রথমে বাছা বাছা কিছু পাহাড়কে (যেমন কিলিমানজারো, ম্যাটারহর্ন, আকোঙ্কাগুয়া, এলব্রুস এবং মাউন্ট এভারেস্ট) ব্র্যান্ডিং করা হয়েছিল এবং তাদের পণ্য করে ইওরোপ এবং আমেরিকায় একের পর জন্ম নিয়েছিল অ্যাডভেঞ্চার বেচার কোম্পানি— অ্যাডভেঞ্চার কনসালট্যান্টস, মাউন্টেন ম্যাডনেস, জ্যাগেড গ্লোব, অ্যাল্পাইন অ্যাসেন্টস ইত্যাদি তারপর, কয়েক বছর যেতে না যেতেই জন্ম নিল লোবেন এক্সপিডিশন, সেভেন সামিটস ট্রেকসের মতো অপেক্ষাকৃত সস্তা দামের এবং নিম্ন মানের নেপালি কোম্পানিগুলি এভারেস্ট এবং সমগোত্রীয় সব ক’টি শৃঙ্গ পরিণত হয়েছিল ইন্ডাস্ট্রিতে বলা হয়েছিল, স্বপ্ন সম্ভবের যুগ এসেছে, ফেলো কড়ি চড়ো এভারেস্ট— ব্যস, তুমিও রাতারাতি পরিচিত হবে অভিযাত্রী হিসেবে বলা বাহুল্য, এমন বিজ্ঞাপনে এসেছিল প্রবল সাড়া প্রথমে ভিড় সামলাতে এবং তারপর সেই খদ্দের ধরে রাখতে, কয়েক বছর পার হতে না হতেই প্রয়োজন হয়েছিল ব্র্যান্ড এক্সটেনশনের ফলে সৃষ্টি হয়েছিলসেভেন সামিটস’, ‘এক্সপ্লোরার্স গ্র্যান্ড স্ল্যামগোছের গালভরা নামের প্যাকেজ ট্যুর প্রথম দিকে এই সব বিজ্ঞাপনের টার্গেট অডিয়েন্স সীমাবদ্ধ ছিল আর্থিক ভাবে সচ্ছল প্রথম বিশ্বের মানুষজনের মধ্যে এভারেস্টের এমআরপি ৬৫ হাজার ডলার ছুঁয়েছিল আর এখন বাংলার গ্রামের ছেলে বা মেয়েটি তার মায়ের গয়না, বাপের জমিজমা বন্ধক দিয়ে, যে-কোনও মূল্যে একটা আট হাজারের শিখরে উঠতে চাইছে কারণ, সে দেখতে পাচ্ছে এভারেস্ট বা সমতুল কিছু পাহাড়ে একবার উঠতে পারলেই টিভি এবং খবরের কাগজের হেডলাইন হওয়া এ পোড়া দেশে নিশ্চিত তার হয়তো মনে হয়েছে, মিডিওক্রিটি থেকে মুক্তি পাবার এটা একটা নতুন শর্টকাট পর্বতারোহণের বাণিজ্যিক প্যাকেজিং-এর সাফল্য তাই আজ এক অতি-ছোঁয়াচে সংক্রমণ। এক প্যানডেমিকের মতোই এই সংক্রমণ আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সব পর্বতমালায়, এমনকী দুই মেরুও বাদ যাচ্ছে নাএভারেস্ট, অন্নপূর্ণা, কাঞ্চনজঙ্ঘা, মানাসলু, চোইউ, ধৌলাগিরি, লোৎসে ইত্যাদি শিখরের কথা বাদই দিলাম, বাণিজ্যিক প্যাকেজিং-এর থাবা কে-টু কেও ছাড়েনি। বিগত দশ বছরে এই পশ্চিমবাংলা থেকে আট হাজারি শৃঙ্গ ‘জয়’ করতে যাওয়ার মিছিল তাই কোনও যুগান্তকারী ঘটনা নয়— বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় অযোগ্য, না হয় ট্যুরিস্ট ক্লাইম্বারদের (ক্ষেত্র বিশেষে দু’টিই) ইগো ট্রিপ। বাঙালির আট হাজারি শৃঙ্গের অভিমুখে যুদ্ধ ঘোষণার হিড়িক, সেই মাপকাঠিতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং সেই দুর্ঘটনাগুলির কারণ বিশ্লেষণ করে ‘ড্রিম ওয়ান্ডেরলুস্ট’ নামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রূপক ভট্টাচার্যের একাধিক নিবন্ধ এ বিষয়ে একাধারে একটি ‘মেটিকুলাস’ ময়নাতদন্ত সিরিজ এবং সতর্কবার্তা   আট হাজার মিটারের পাহাড়ে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পর্বতারোহীদের দূর্ঘটনার বাৎসরিক পুনরাবৃত্তির কারণ যে মূলত সাবজেক্টিভ হ্যাজার্ড, সে প্রসঙ্গে ডঃ ভট্টাচার্য একজায়গায় লিখেছেন, “পর্বতারোহণ ঝুঁকির খেলা। এতে দুরকম প্রতিবন্ধকতা, অবজেক্টিভ এবং সাবজেক্টিভ। প্রথমটি পাহাড়জনিত, তার উচ্চতা, কাঠিন্য, আবহাওয়া ইত্যাদি। দ্বিতীয়টি পর্বতারোহীজনিত, তাঁর শিক্ষা, মানসিকতা, স্বাস্থ্য, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। তাই পাহাড়ে ঘটা যেকোনো দূর্ঘটনার কারণ বিচার করতে হবে এই দুরকম মাপকাঠি দিয়ে। অবজেক্টিভ হ্যাজার্ড (প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা) সবার জন্য সমান। তফাৎ করে দেয় সাবজেক্টিভ হ্যাজার্ড। পর্বতারোহীর পর্বতারোহনের তাত্ত্বিক এবং ফলিত শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, মানসিকতা, স্বাস্থ্য, ইত্যাদি, যত পর্বত আরোহণের অনুকূল হবে তত কম হবে তাঁর ‘সাবজেক্টিভ’ প্রতিবন্ধকতা”।   

আট হাজারি শৃঙ্গগুলি জুড়ে মাউন্টেনিয়ারিং ট্যুরিজমের জমজমাট ব্যবসা এবং সেই ব্যবসায় খরিদ্দার হিসেবে ভারতীয়দের বিপুল সংখ্যায় যোগদানের বিষয়ে লিভিং লেজেন্ড রাইনহোল্ড মেসনার ২০১৭ সালে এক ইন্টারভিউতে বলেছেন, “Climbing has totally changed. This year maybe 200 Indians will go to Everest on the piste [a track of firm snow] and since it is possible that Everest is prepared from the base to the summit, many people can go there. But this is not alpinism, this is tourism. People are buying the possibility to go up the piste on Everest. বিগত তিন দশকে বিশ্ব জুড়ে পর্বতারোহণ দর্শনের দৈন্য দেখে ডগ স্কট তো একেবারে রাখঢাক না করেই বলেছেন, “যাদেরই পকেটে টাকা আর মনে ইনস্ট্যান্ট সেলিব্রিটি হবার শখ ছিল তারা তাদের সেই স্বপ্ন কিনতে পেরেছে” ২০০৩ সালে বিবিসি-কে দেওয়া একটি ইন্টারভিউতে স্যার এডমন্ড হিলারি বলেছিলেন, “Having people pay $65000 and then be led up the mountain by a couple of experienced guides isn’t really mountaineering at all”আর এই ২০২০ সালের এপ্রিল মাসেঅ্যাডভেঞ্চার মাউন্টেন’ পত্রিকার এক ইন্টারভিউতে ক্রিস বনিংটন বলেছেন, “What’s happening on Everest? I mean, commercial expeditions on Everest have absolutely nothing to do with climbing whatsoever.”

তবে, বনিংটন-ডগ স্কটরা কী বলছেন এবং পর্বতারোহীদের মধ্যে কীরকম দার্শনিক এবং পরিণত ধ্যানধারণা থাকা উচিত, এসব বিষয়ে কথা বলা আজ এই দেশ, বিশেষ করে এই রাজ্যে ভস্মে ঘি ঢালার সমতুল্য। খবরের কাগজ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে তাকালেই সেকথা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। এদেশে যারা এভারেস্ট, কিংবা সমতুল ঘরানার, অর্থাৎ, ৮০০০ মিটারের কোনও পাহাড়ে ওঠেন তাঁরাই রাতারাতি পূজিত হন। সেই পূজা পর্বতারোহণ-মূর্খ কোনও সাংবাদিকের উচ্ছ্বসিত রিপোর্টেই থেমে থাকে না, খোদ সরকার বাহাদুরও সময় বিশেষে এই দিগ্বিজয়ী বীরদের কখনও সম্মানীয় পদ কখনও সুবর্ণ পদক ইত্যাদিতে ভূষিত করে থাকেন। একবারও ভাবা হয় না যে, এই স্বঘোষিত, দিগ্বিজয়ী অভিযাত্রীরা আসলে শেরপা এবং স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সির অ্যাডভেঞ্চার কেটারিং সার্ভিসের সম্মানীয় ক্রেতা। যুবসমাজকে একবারও ভেবে দেখার সময় দেওয়া হয় না যে, মাউন্টেন ট্যুরিজম এবং মাউন্টেনিয়ারিং— এই দু’টির মধ্যে তফাত আকাশ এবং পাতালের, সোনা এবং সোনার পাথরবাটির। একই চিত্রনাট্য পুনরাবৃত্ত হয় ভারতীয় হিমালয়ে মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবগুলির দ্বারা আয়োজিত ‘অভিযান’-এ। শেরপারা কাজ করেন, বাবুরা বলেন করেছি। বলেন, ফিক্সড রোপে জুমার লাগানো দেখতে পাচ্ছেন তো কী হয়েছে, আসলে আমরা নিজেরাই ক্লাইম্ব করেছি; জুমার তো প্রপঞ্চময় মায়াসত্যি, কম ঝক্কি পোয়াতে হয় শেরপা ভাইদের! এদিকে, এই সমস্ত ‘গাইডেড’ এবং ‘ফুল সার্ভিস’ অভিযান যে আদতে কুণ্ডু ট্রাভেলসের সঙ্গে চারধাম ভ্রমণের হাই-অল্টিচিউড ভারশন, তা আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাই না। এক্সপিডিশন থেকে ফেরা বাংলার বনিংটনরা তার পর থেকে দূর্গাপুজার ফিতে ছাড়া আর কিছু কাটেন না এবং দেখা দেন আগামীকালের পর্বতারোহণের উপদেষ্টা, এমনকী, নীতিনির্ধারক রূপে এতক্ষণে, পাঠক নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পেরেছেন যে, পিউরিস্ট পর্বতারোহীদের একসময়ে দেখা উত্তরণের স্বপ্ন, ঠিক কোন বেনো জলের প্লাবনে বাংলায় দানা বাঁধতে পারেনি! নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, স্বল্প সময়ের জন্য সীমিত মানুষজনের মধ্যে সেই চেতনা এসে থাকলেও, কেন তা সর্বব্যাপী এবং দীর্ঘমেয়াদি হয়নি।

ক্রমশ...

দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্ত  

(দ্বিতীয় পর্বের লিংক)

Illustration courtesy: Freevector 

Saturday, June 5, 2021

বিকাশের অসুখ




বিকাশের অসুখ 

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়

 ২০১৩। সম্ভবত জুন কিংবা জুলাই। তারিখটা সঠিক মনে পড়ছে না এই মুহুর্তে। আসলে হয়ত মনে করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিশ্রমটুকুও করতে রাজি নই আমি আজ। দিন, মাস, কিংবা তারিখে কিই বা আসে যায়? বিশেষত, যখন সেই দিন আমি এবং আমার সঙ্গীরা কেউই মারা যাই নি। বহাল তবিয়তে দিব্যি বেঁচে আছি আজও। মারা গেলে অবশ্য, সেই দিন, মাস, কিংবা বছর; কিছু মানুষের কাছে মন খারাপের বিষয় হয়ে উঠত। কয়েক বছরের জন্য হলেও, হত। শোক সাময়িক, উচ্ছ্বাস তাৎক্ষণিক, এবং আনন্দ চিরন্তন। তবে স্মৃতি সিলেক্টিভ অ্যামনেসিয়ায় ভোগে। পছন্দের জিনিষ ঠিক মনে থাকে। বাকি সব কিছু, কিছু দিনের। তাই ইতিহাস পড়া হয়। শেখা হয় না। এই আমাদের রক্তশূন্য সভ্যতা। প্রতিদিন ঘুম ভাঙে মিথ্যা এবং প্রবঞ্চনায়। চোখ বুজি স্তোকবাক্যে। সভ্যতার গল্পে আজকাল বিশ্বাস হয় না আর।

যাই হোক, সেই বছর উত্তরাখণ্ডে ক্লাউড বার্স্ট হয়েছিল। ‘ক্লাউড বার্স্ট’-ঘন কালো বিদ্যুৎ চমকানো মেঘের মত একটা নাম। বার্স্ট, অর্থাৎ, বিস্ফোরণ। বাংলা ভাষায় কেউ মেঘ ফেটেছে না বললেও, হিন্দিতে ‘বাদল ফাট গয়া’, বলা হয়। যেকোনো বিস্ফোরণের মধ্যেই, তা সে টেররিস্টের হোক, কিংবা প্রকৃতির; একটা চমক থাকে। মানুষকে হতবাক করে দেবার ক্ষমতা থাকে। ক্লাউড বার্স্ট সেরকমই এক জিহাদ, প্রকৃতির মৌলবাদ। তো, সেই বিস্ফোরণের সময়, আমরা কয়েকজন আটকে পড়েছিলাম ত্রিশূল পাহাড়ের ওয়েস্ট ফেসের একেবারে পায়ের তলায়। নেহাতই ঘটনাচক্রে। ‘ওয়েস্ট ফেস’ কথাটা এখন লিখতে গিয়ে মনে হল, আমরা যাকে পাথর কিংবা বরফের দেওয়াল দেখি; সাহেবরা সেখানে মুখ দেখতে পায়। আর মুখ থাকলেই তার একটা পরিচয় থাকে, চরিত্র থাকে। তখন, অচেনা হলেও তার দিকে হাত বাড়িয়ে ‘হ্যালো’ বলা যায়। আমাদের ক্লাইম্বিং যেখানে দুরূহ দেওয়াল দেখে থমকে যায়, ওরা সেখানে মুখের অবয়ব খুঁজে পায়। সম্ভবত, এই প্রাণসন্ধানী মানসিকতাই ওদের ক্লাইম্বিং এর কাজটা সহজ করে দেয়। আমরা হাঁ করে পাঁচিলের নীচে দাঁড়িয়ে থাকি। দড়িদড়া বেঁধে যুদ্ধ জয়ের মহড়া দিই। ওদের আলাপ সখ্যতায় গড়ায়। 

দেওয়ালের মুখ দেখব, এই সঙ্কল্প নিয়েই সেবার কজন গিয়েছিলাম ত্রিশূল। কিন্তু, মেঘ ফাটবে, প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে; এমন সম্ভাবনা দুঃস্বপ্নেও কারো মাথায় আসেনি। বর্ষা বলে কয়ে আসে। মেঘ নোটিস দিয়ে ফাটে না। এই আকস্মিক চরিত্রের জন্যই সে বিস্ফোরণ, দহন নয়। তিনদিন, একটানা বৃষ্টি পড়েছিল। আমরা অবাক হয়েছিলাম এত উচ্চতায় বৃষ্টির ফোঁটার আয়তন দেখে। আমাদের মধ্যে কেউ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল, গ্লোবাল ওয়ার্মিং। বৃষ্টি পড়া বন্ধ হতে না হতেই, বরফ পড়া আরম্ভ। এতদিনে আমাদের সবকটা তাঁবুই অল্পবিস্তর ছিঁড়ে গিয়েছিল। এবার তাজা বরফের ভারে তারা আমাদের গায়ে নুয়ে পড়তে লাগল। খাবার সদ্য শেষ হয়েছিল। কেরোসিন ছিল, তাই স্টোভ জ্বলছিল। ডেকচিতে চাপান বরফ গলছিল। আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল না। তবু, শরীরের ক্ষমতা, একটু একটু করে ফুরিয়ে আসাটা বেশ জানান দিচ্ছিল। মগজের একটা দিক বলছিল, এভাবেই বরফ চাপা পড়ে এবার মারা যাব আমরা সকলে। মগজের অন্য একটা দিক অঙ্ক কষছিল, বাঁচার অঙ্ক। ঘুমিয়ে পড়া, জেগে ওঠা; শরীরের এই দুটো কাজই বেশ দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। ঘুমিয়ে পড়লেই ধড়মড়িয়ে জেগে ওঠা। তাঁবুর গা যতটা সম্ভব বরফমুক্ত রাখা, অকারনে একে অপরকে চেঁচিয়ে ডাকা;এসব চলছিল যান্ত্রিক ভাবে। আমাদেরও মুখ আছে, নাম আছে; সেগুলো মনে থাকাটা অসম্ভব জরুরী হয়ে পড়ছিল। হতাশার পাল্লা একটু একটু করে ভারী হচ্ছিল। মেঘ কাটছিল না। বরফ পড়া থামছিল না। তাঁবু জলে ভাসছিল। আমাদের জ্যাকেট এবং স্লিপিং ব্যাগ, আমাদের শরীরের উষ্ণতা রক্ষার বদলে, শুষে নিচ্ছিল। আমরা অবশ হয়ে আসছিলাম। মৃত্যুকে মেনে নিচ্ছিলাম। চারদিন গড়িয়ে যেদিন পাঁচ, সেদিন চারদিক থেকে অ্যাভালাঞ্চ নামা আরম্ভ হল। আমরা ঘড়ি মিলিয়ে দেখলাম, প্রতি ছ মিনিটে একটা অ্যাভালাঞ্চ। একদম বুক কাঁপানো, হাড় হিম করা। এতদিন হিমবাহের মধ্যে দ্বীপের মত জেগে ওঠা একটা মোরেন দেওয়ালের মাথায় আস্তানা গেড়েছিলাম। গোটা হিমবাহে আমাদের এই ক্যাম্পসাইটকে মনে হয়েছিল সবথেকে নিরাপদ ঠিকানা। সেদিন সকালে সেই ক্যাম্পসাইটই যেন বলল, ভাই, অনেক রক্ষা করলাম তোমাদের। এবার তোমরা অন্য পথ দেখ। ক্যাম্পসাইট কথা বলে না, আমি জানি। নুড়ি পাথর, বড় বোল্ডার, মিছরি দানার মত বরফ; এরা কেউ কথা বলে না। কিন্তু এদের সঙ্গেই গত পাঁচদিন ধরে দিব্যি কথা বলছিলাম আমি। অনেক কথা। জমে থাকা, না বলা, ভুলে যাওয়া সব কথা। সব উজাড় করে ওদের বলছিলাম। আমার অস্তিত্ব ওদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল, আর ওদের ঔদাসিন্য আমার মধ্যে। তাই ক্যাম্পসাইট যখন উচ্ছেদের নোটিস হাতে ধরাল, তখন বললাম, যাব কোথায়? কীভাবে? চলার ইচ্ছেটাই চলে যাচ্ছে ক্রমশ। তুমি বরং একটা গল্প শোন। শুনবে? 

ক্যাম্পসাইট কিছু বলে না। সব শুনতে চায়। হয়ত সত্যিই সব শুনতে পায়। তাই বলে চলি। আমাদের পাড়ায় এক পাগল ছিল। নাম ছিল বিকাশ। অদ্ভুত ছিল তার পাগলামি। সোজা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নিজেই নিজের পিঠে টোকা মারত। যেন পিছন থেকে কেউ তাকে ডাকছে। সঙ্গেসঙ্গেই পিছন ফিরে হাঁটা লাগাত সে। আবার কিছুক্ষণ পর সেই একই কাজ। নিজে হাতে নিজের পিঠে টোকা। নিজেকে পিছন থেকে ডাকা এবং অ্যাবাউট টার্ন। পাগলের আর কোথাও পৌঁছনো হত না। একসময় ওর এই পিছুটানের খেলা আমাদের কাছে একঘেয়ে হয়ে যেত। আমরা অন্যকিছু দেখতাম। ও ক্লান্ত হত না। ঘুরেই যেত। কিছুক্ষণ পর খেয়াল হতেই দেখতাম পাগল আর নেই। অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমরা অবাক হয়ে যেতাম। ওর তো একই রাস্তায় ঘুরপাক খেয়ে মরার কথা ছিল! তাহলে ব্যাটা গেল কোথায়? আগে গেল? না পিছনে? ও কি এক পা এগোলে, দু পা পিছোয়? নাকি, উল্টোটা? ও কি সরলরেখায় হিসেব করে পা ফেলে? নাকি, ধীরে ধীরে বৃত্তের পরিধি ছোট করে আনে। তারপর এক নির্দিস্ট বিন্দুতে পৌঁছে হুস করে ভ্যানিস হয়ে যায়? ও কি মানুষ? নাকি, অন্য কোন ডাইমেনসন থেকে ভুল করে এসে আটকে পড়েছে বেলুড় বাজারে। সেই পাগল বিকাশকে অবশ্য দেখতে পাইনা আজকাল। সম্ভবত সে মারা গেছে কোন ফুটপাথে কুঁকড়ে শুয়ে। কিংবা, অন্য ডাইমেনসন থেকে ওর বন্ধুরা এসে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। এখন হয়ত ও বেশ ভাল আছে। আমি বলেই চলি। ক্যাম্পসাইট হাঁ করে শোনে। 

পাগলের গল্প কেন শোনালাম? আসলে আমার তখন মনে হচ্ছিল, আমরা সবাই পাগল। অবিকল সেই বিকাশের মত। আমাদের সভ্যতার মস্তিষ্ক বিকৃতি বিস্তর। তা না হলে, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর; বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া প্রকৃতির মৌলবাদ উপেক্ষা করে থাকি কী করে? সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম, অদ্বৈত বেদান্ত এবং ঘুঁটে; সব সমান এই মৌলবাদের চোখে। সবই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আমরা কেন বুঝেও বুঝতে চাই না, সভ্যতার লক্ষ সমস্যার থেকে বড় বিষয়, প্রকৃতি। বারবার সে আমাদের সাবধান করে দেয়। আমরা হায় হায় করে উঠি। কখনও সুনামি, কখনও ভূমিকম্প, কখনও ক্লাউড বার্স্ট। কখনও নিকোবর, কখনও পাকিস্তান, কখনও উত্তরাখণ্ড। তবু বিস্ফোরণের আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই আমরা ফিরে যাই পটল কুমার কিংবা আইপিএল-এ। নিজের পিঠে নিজেই টোকা মারি। আবার পিছন ফিরে হাঁটি। আমরা পাগল নই? 

ছ নম্বর দিনে মেঘ কেটে যায়। একটুকরো নীল দেখা দেয়। আমরা নিঃশব্দে তাঁবু গুটিয়ে নামা শুরু করি। প্রকৃতির আরও এক হুঁশিয়ারির সাক্ষী আমরা। বার্তা পৌঁছে দিতে হবে বাকি বন্ধুদের কাছে। জানি কেউই শুনবে না আমাদের কথা। তবে হয়ত, পঞ্চাশ কিংবা একশো বছর পর কারো টনক নড়বে। তখন হয়ত অনেক দেরী হয়ে যাবে। বেলুড় বাজারের বিকাশ পাগলের মতই আমরাও ভ্যানিস হয়ে যাব। অন্য কোন ডাইমেনসনে ফিরে যাবার পথ আমাদের কোনদিনই ছিল না। আজও নেই। তবু সেই প্রাণ নিয়ে কোনমতে বেঁচে ফেরার মুহুর্তে আরও গভীর ভাবে ভালো লাগে ক্যাম্পসাইটকে। নিষ্প্রাণ হিমবাহকে বড় দয়ালু মনে হয়। মনে হয়, এই প্রকৃতি ঠিক আমার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের মত। বার্ধক্য, জরা পঙ্গুপ্রায় করেছে। তবু আমায় গভীর ভালবেসে তাঁরা বেঁচে আছেন। আর আমি ভাবছি, আগামীকালও ঘুম থেকে উঠে বাবাকে দেখব। একসঙ্গে চা খাব। মা বলবে, আজ আর কোথাও বেরোস না। বড্ড মেঘ করেছে।

সমাপ্ত 

লেখকের মন্তব্যঃ লেখাটি ২০১৬ সালে 'যারা পরিযায়ী' পত্রিকার পূজা সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল । লেখার সময় অমিতাভ ঘোষের 'দি গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট' আমাকে প্রভাবিত করেছিল।  

Discovering Ladakh’s Uncharted Petroglyphs : A Short Note

  Whispers on Stone: Discovering Ladakh’s Uncharted Petroglyphs We were trudging down a dusty trail by the frozen stream near the little v...