Sunday, September 29, 2019

ভোলাকাকুর স্বর্ণযুগ


ভোলাকাকুর স্বর্ণযুগ

লেখকের  ব্যক্তব্যঃ এই লেখাটি সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকায়  ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ এ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদ  প্রতিদিনের লেখাটির সঙ্গে যে ছবিটি 'বাস্তবে গুমনামি বাবার ছবি' বলে ছাপা হয়েছে সেই ছবিটি আদপে যে 'বাস্তব'  নয়, এক শিল্পীর মনগড়া, তাও প্রমাণিত হয়ে গেছে। এই লিঙ্কে গেলেই সেটা বিষদে জানা যাবেঃ https://scroll.in/article/757089/how-a-computer-generated-image-came-to-be-used-as-proof-that-a-mysterious-sadhu-was-actually-netaji

খবরের কাগজের পাতার ডিজাইন এবং কোন ছবি তাঁরা ব্যবহার করবেন, তার ওপর লেখকের কোন নিয়ন্ত্রণ সাধারনত থাকে না। এক্ষেত্রেও ছিল না। যাই হোক, এই লিঙ্কে গেলে কাগজের লেখাটি পড়া যাবেঃ https://epaper.sangbadpratidin.in/epaper/m/389654/5d8ffdaa0316a  


শুরুটা অনেকটা হযবরল-র মত। বেজায় গরম। ধর্মতলা চত্বরে একটা কাজ সারতে গিয়ে হাঁসফাঁশ করছি। এমন সময় ভোলাকাকুর ফোন এল। তিব্বতে যাবার উপদেশ না দিয়ে কাকু সরাসরি বাবায় চলে গেলেন। পৃথিবীতে এক বিশেষ শ্রেণীর মানুষ আছেন যারা গোটা প্যারাগ্রাফ শেষ না করে থামেন না। খুঁজে দেখবেন, আপনার কাছেপিঠেই এই ধরণের মানুষ পেয়ে যাবেন। ভোলাকাকু সেই গোত্রের, তাই, বোবা হয়ে গিয়ে শুনতে লাগলাম। কাকু বলে চললেন- ‘বাবা, অর্থাৎ, গুমনামি বাবার কথা বলছি রে। আমি তো প্রথম থেকেই জানতাম। এবার সিনেমা হয়ে আসতে চলেছে। হুঁহুঁ বাবা, এইবার দুধ কা দুধ, পানি কা পানি হওয়া আটকায় কে! ওরে, আমাদের নেতাজীই যে এতদিন ঘাপটি মেরে গুমনামি বাবা সেজে বসেছিলেন, তা বুঝতে কি আর এত সময় লাগে রে? আমাদের পটলার কথা মনে আছে তো? সেই যে একবার ক্লাস এইটে ফেল করে বাড়ি থেকে পালালো যে পটলা? হ্যাঁ, তার কথাই বলছি। তো সেই পটলাকে, পাক্কা দশ বছর পরে, কীভাবে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল তা জানিস কি?’ আমি ‘না’ বলার আগেই উল্টোদিক দিক থেকে উত্তর এল, ‘ওর ছাগলের মত কান দেখে। আরে সেই যে সেবার বটতলা ট্রাভেলসের সঙ্গে বেনারস গেছিলাম না? সেবারেই তো মোগলসরাই স্টেশনে একেবারে হাতেনাতে পাকড়াও করে আবার আমাদের খড়দা ফিরিয়ে আনলাম। যতই দাড়িগোঁফের জঙ্গল বানাও, ঐ লম্বকর্ণ লুকোবে কী করে? একেবারে কান ধরে টেনে তুললাম আমাদের বগিতে। তুই নিশ্চয়ই ভাবছিস নেতাজীর সঙ্গে পটলার কি সম্পর্ক? বুঝলি না তো? বুঝবি কী করে? বুঝতে চাস না যে। আরে গুমনামি বাবা হয়ে যতই দাড়িগোঁফের আড়ালে তিনি নিজেকে রাখুন না কেন, ঐ হাসি, ঐ চোখ, ঠিক ওনাকে ধরিয়ে দেবে। এতদিনে একটা কাজের কাজ হল বটেযেই সোনালি হলে সিনেমাটা লাগবে, আর সঙ্গেসঙ্গে ভারতবর্ষের সবথেকে বড় রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে,’ এই পর্যন্ত বলে, যেই ভোলাকাকু একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়েছেন ওমনি আমি, ‘ঠিক বলেছ ভোলাকাকু, তবে এখন আমার বাস এসে গেছে, পরে আবার শুনছি, কেমন,’ বলেই ফোনালাপে দাঁড়ি টেনেছি। 


বেলুড়মঠ-ধর্মতলা মিনিবাস আসলে ইতিহাসের জগদ্দল পাথরের মত এক যাত্রী পরিষেবা বিগত চল্লিশ বছরে তার মধ্যে কোন রদবদল, এমনকি জানলার রড-বদল, কোনটাই ঘটেনি এবং সম্ভবত আগামী চল্লিশ বছরেও তাঁরা সেই ট্র্যাডিশন এই ভাবেই বজায় রাখবেন। সেই ঘুপচি টিনের বাক্স, সেই হাঁটু ঘষা সিট এবং তাতে ঠাসা সহযোদ্ধার দল কোন একটা বাস স্টপ এলে যে ভাবে লোকজন হৈহৈ করে নামে, তাতে ট্রোজান হর্সের পেট থেকে বেরিয়ে আসা গ্রীক সৈনিকদের কথাই মনে পড়ে যায়; তাই সহযোদ্ধাই বললাম তবে সেদিন কী যে হল, আমি হুট করে জানলার ধারে বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। বসতে না বসতেই আবার ফোন বেজে উঠল, আবার ভোলাকাকু। এবার অবশ্য ধরার আগেই ফোনটা কেটে গেল। কেন জানি না, সেই মুহুর্তে আমার মনে হল, ভোলাকাকুরা কমবেশি পৃথিবীর সব জাতির মধ্যেই আছেন এবং এক বিপুল সংখ্যাতেই আছেন। এঁরা বিশ্বাস করেন, আমেরিকানরা চাঁদে পা রাখেন নি, ওটা হলিউডি কারসাজি ছিল। যীশু খৃষ্ট আশি বছর বেঁচেছিলেন, তাঁর শেষ জীবন লাদাখে কেটেছিল, শ্রীনগরে তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছিল। চৈতন্যদেবকে পান্ডারা পুরীর মন্দিরের গরুড় স্তম্ভের পাশে পিটিয়ে মারার পর, তাঁকে তোটা গোপীনাথে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। দেবতারা আসলে গ্রহান্তরের মানুষ। দিল্লীর মরচে-বিহীন লৌহস্তম্ভ ভিনগ্রহের প্রাণীরা এসে বানিয়েছিল। টুইন টাওয়ারের উগ্রপন্থী হানা জর্জ বুশ নিজে করিয়েছিলেন।মার্কিন এক ডলারের নোটে ছাপা ‘আই অফ প্রভিডেনস’ আসলে গুপ্ত সমিতি ‘ইলিউমিনাতি’র স্বাক্ষর। বিশ্ব বিখ্যাত রক ব্যান্ড ‘বিটলস’ এর পল ম্যাকার্টনি ১৯৯৬ সালেই মারা গেছিলেন এবং সেই থেকে একই রকম দেখতে একটা লোককে পল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং একটা ভাঁওতা, কারণ এই শীতেও ইওরোপ এবং আমেরিকায় খুব বরফ পড়েছে এবং সব শেষে, আজকের হট টপিক, গুমনামি বাবাই ছদ্মবেশী নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস।  এইরকম সব বিচিত্র ব্যাপারস্যাপার ভোলাকাকুর মত মানুষজনকে সর্বদাই সজীব এবং তাঁদের পরিচিত মানুষজনকে উদগ্রীব করে রাখে। অবশ্য এতদিনে আমি হাড়েহাড়ে বুঝে গেছি যে ভোলাকাকুর ভোলাভালা সরল মনে, ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিকেরা উচ্চমানের গবেষক এবং ডেভিড ইকে, এরিক ফন দানিকেন, অ্যালেক্স জোনস-দের মত প্রমাণিত ভাঁওতাবাজরাই অবিসংবাদী সত্যান্বেষী হয়ে বসে আছেন।  


নেতাজী বিমান দুর্ঘটনায় সত্যিই মারা গেছেন কিনা এ বিষয়ে সুনিশ্চিত হতে কেবল ভারতীয়রাই সচেষ্ট ছিলেন না। ব্রিটিশ, জাপানি এবং আমেরিকানরাও পৃথক ভাবে, বহুবার তাদের তদন্ত চালিয়েছিলেন। প্রত্যেকবারই, তদন্তকারী ব্যক্তি কিংবা কমিশনগুলি একটিই সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছিলেন- ১৮ আগস্ট, ১৯৪৫, তাইহোকু এয়ার স্ট্রিপে, বিমান দুর্ঘটনায় মারাত্মক রকম জখম এবং গুরুতর ভাবে দগ্ধ হয়ে নেতাজীর মৃত্যু হয়েছিল। জ্বলন্ত, বিধ্বস্ত, ভেঙে পড়া বিমান থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে বেরিয়ে যখন নেতাজীর মুখোমুখি হয়েছিলেন হাবিবুর রহমান, তখন তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল সেই মুখ তখন ‘ব্যাটার্ড বাই আয়রন, বার্নট বাই ফায়ার’। সেই বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো একমাত্র হতভাগ্য ব্যক্তি ছিলেন না নেতাজী, যেমন ছিলেন না হাবিবুর রহমান একমাত্র বেঁচে থাকা সাক্ষী। সেই একই দুর্ঘটনায় মারা গেছিলেন নেতাজীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী জেনারেল সুনামাসা শিদেই-ও। জেনারেল শিদেই-এর পরিজনেরা কোনদিন তাঁর মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেননি। শাহনয়াজ খান কমিটির সদস্যেরা জাপানে গিয়ে জেনারেল শিদেই-এর সার্ভিস রেকর্ডে দেখেছিলেন লেখা আছে- মৃত্যুর তারিখ ১৮ আগস্ট, ১৯৪৫, মৃত্যুর স্থান- তাইহোকু এয়ার স্ট্রিপ, মৃত্যুর কারণ- ডেথ বাই ওয়ার। একজন সৈনিকের কাছে এর থেকে সম্মানের আর কিছুই হতে পারে না। হাবিবুর রহমান ছাড়াও আরও ছ’জন জাপানি সহযাত্রী প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। এই ছ’জন জাপানি সৈনিকের মধ্যে পাঁচজন- লেফটেন্যান্ট কর্নেল শিরো নোনোগাকি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাদেও সাকাই, মেজর তারো কোনো, ক্যাপ্টেন কেইকিচি আরাই এবং মেজর ইহাহো তাকাহাসিকে একাধিক বার ভারতের, ব্রিটেনের এবং জাপানের বিভিন্ন সময়ে গঠিত কমিশনের প্রতিনিধিরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। তাইহোকু এয়ার স্ট্রিপের গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা এবং গ্রাউন্ড স্টাফেরা, যারা সেই অভিশপ্ত ‘টুইন-ইঞ্জিন হেভি বম্বার অফ ৯৭/২ (স্যালি)’ মডেলের বিমানটিকে শেষবার দেখভাল করেছিলেন এবং বিমানটি ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন, তাঁদেরও বয়ান নেওয়া হয়েছিল। নেতাজীর জীবনের শেষ কয়েক ঘণ্টায় যারা তাঁর প্রাণ বাঁচানোর প্রচেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন, তাইপেই নানমোন মিলিটারি হাসপাতালের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সার্জেন ডঃ ক্যাপ্টেন ইওশিমি তানেওশি, তাঁর সহকারী ডঃ সুরুতা, এমনকি সেই চিনা নার্স সান পি শা-কেও খুঁজে বার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। নেতাজীর মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত ছিলেন ইনটারপ্রেটার নাকামুরা। নাকামুরা যখন হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন, তখনও নেতাজী কথা বলছেন। নাকামুরাকে নেতাজী বলেছিলেন, ‘আমার আরও কিছু লোক আমার পরেই ফরমোসা এসে পৌঁছবে। ওদের একটু দেখাশোনা করবেন’। তাঁর আধ ঘণ্টা পরেই খোঁজ নিয়েছিলেন, জেনারেল শিদেই কোথায়? তার কিছু পরে, রাত ন’টা নাগাদ বলেছিলেন, ‘আমি একটু ঘুমোতে চাই’। সেই নেতাজীর শেষ কথা। নাকামুরা, মেজর নাগামোতো এবং হাবিবুর রহমানের উপস্থিতিতে নেতাজীর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল। নাকামুরা, নাগামোতোর বয়ানও নেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৫ এর সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৭৪ পর্যন্ত সময়ের বিস্তারে সেই ইন্টারভিউ গুলি ঘটেছিল বিভিন্ন স্থানে এবং বিচ্ছিন্ন ভাবে। এঁদের প্রত্যেকের বিবরণের সঙ্গে হাবিবুর রহমানের রিপোর্ট হুবহু মিলে গিয়েছিল। সকলেই নিঃসংশয় ছিলেন বিমান দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর ব্যাপারে।


সকলেই, কিন্তু, একজন ছাড়া। ফয়জাবাদের জনৈক গুমনামি বাবাই স্বয়ং নেতাজী- প্রথম থেকে এই কথা একরকম ঘোষণাই করে,  ১৯৯৯ সালে আসরে নেমেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক মনোজ মুখার্জি, শুরু হয়েছিল নেতাজী-মৃত্যু ‘রহস্যে’ আরও এক কমিশন। এবং রহস্য গল্প গিলে খাওয়ার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি বশতই মুখার্জি কমিশন জনমানসে বেশ সাড়া ফেলেছিল। যথা সময়ে, মুখার্জি কমিশনের সুপারিশ মত, গুমনামি বাবা এবং বসু পরিবারের ডি এন এ পরীক্ষা করে তুলনা করা হয়েছিল। আবার, নেতাজীর হাতের লেখার সঙ্গে গুমনামি বাবার হাতের লেখা বিশেষজ্ঞকে দিয়ে মিলিয়ে দেখাও হয়েছিলকিন্তু, শেষ পর্যন্ত এসবের কোনটাই যখন মেলেনি, তখন কমিশন গঠনের সাত বছর পর, এক বিচিত্র রিপোর্ট পেশ করেছিলেন মনোজ বাবু। সেই রিপোর্টে উনি জানিয়েছিলেন, ১৯৪৫ এর ১৮ আগস্ট, তাইহোকুতে নাকি কোন বিমান দুর্ঘটনাই ঘটেনি। অবশ্য, ২০১০-এর একটি ইন্টারভিউতে একথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে প্রথম থেকেই একটা পুর্বকল্পিত ধারনা নিয়েই তিনি তাঁর কাজে নেমেছিলেন। বলা বাহুল্য, পার্লামেন্টে মুখার্জি কমিশনের সেই রিপোর্ট বাতিল হয়ে গিয়েছিল। একথা ঠিক যে, দেশ স্বাধীন হবার পর, প্রথম কয়েক দশক জুড়ে নেতাজীর এই রকম মৃত্যু দেশের এক বড় অংশ স্বাভাবিকভাবেই অন্তর থেকে মেনে নিতে পারেনি। এক না একদিন তাদের দেশনায়ক ঘরে ফিরবেন, এই বিশ্বাস অনেকদিন ধরেই প্রবহমান ছিল। জনগণের এই আবেগকে কাজে লাগিয়েছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ এবং কিছু বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দল। জন্ম নিয়েছিল একের পর এক ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব। আজ অবধি নেতাজীকে অমুক জায়গায় তমুকের বেশে দেখতে পাওয়া গেছে বলে যতগুলি বিভ্রান্তিকর তত্ত্ব প্রচার করা হয়েছে, তাঁর কোনোটিরই কোন বাস্তবসম্মত প্রমাণ পাওয়া যায় নি  


শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, মার্কিন জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ কোনও না কোন ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে ‘বিশ্বাস’ করেন। ব্রিটিশ মনস্তত্ত্ববিদ ক্যারেন ডগলাস তাঁর এক সাম্প্রতিক প্রবন্ধে এই ‘কনস্পিরেসি থিয়োরিস্ট’-দের কোনও একটা ঘটনায় ‘বিশ্বাস’ এবং সেই বিশ্বাসের লাগাতার প্রচারের কারণ হিসেবে একধরনের আত্মমুগ্ধতার প্রতিপালন এবং কোন একটা প্রচ্ছন্ন অভিসন্ধিকে দায়ী করেছেন। প্রথমটি, আত্মমুগ্ধতা। আমিই সব থেকে সুন্দর, আমি সবার থেকে একটু আলাদা, আমি অন্যরকম সিনেমা বানাই- এই ধরনের নারসিসিজম আর কী! দ্বিতীয়টি, অভিসন্ধি, মোটিভ- তা হতে পারে রাজনৈতিক, বানিজ্যিক কিংবা আরও অন্য কিছু। ষড়যন্ত্র-ত্বত্ত্ব, গুজব ইত্যাদি বাজারে চিরকালই ‘খায়’ ভাল। তবে, তাইহোকু বিমানবন্দরে একটি বিমান ভেঙে পড়া এবং সেই দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যুর দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটিকে নতুন করে এক ‘অন্তর্ধান রহস্যের মোড়কে’ বই এবং চলচ্চিত্র রূপে পেশ করার পিছনে কেবলমাত্র বাণিজ্যিক বিপণন নেই। এখানেও সেই একই আত্মপ্রচার এবং প্রচ্ছন্ন অভিসন্ধির গড্ডলিকা কাজ করে চলেছে। বুঝিয়ে বলছি।  

  
কগনিটিভ সাইকোলজির অধ্যাপক ডেভিড লুডেন ‘সাইকোলজি টুডে’তে লিখেছেন, “ষড়যন্ত্র তত্ত্ব গুলি আসলে কিছু ভ্রান্ত ধারনার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। যেমন ধরুন, হয়ত কারো ধারনা ছিল অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী সিডনি। কিন্তু যেই সে জানতে পারল, সিডনি নয়, অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী আসলে ক্যানবেরা, একটু অবাক হলেও, সে নিজের ভুল শুধরে নিল। কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে কোন ভ্রান্ত ধারনাকে প্রতিষ্ঠা করার নেপথ্যে কোন অভিসন্ধি থাকে, সেক্ষেত্রে ভুল শুধরে নেওয়াটা সহজ হয় না।” এটা আসলে বিপণনের এক প্রাচীন পদ্ধতি- বোঝাতে না পারলে, বিভ্রান্ত করে দাও কনভিনস করতে ব্যর্থ হলে, কনফিউস করে দাও। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ এর কথা। আমরা জানি, প্রকৃতির বিরূদ্ধে গিয়ে মানুষের ধ্বংসাত্মক কাজকর্মের জন্য বিশ্বের উষ্ণতা বিপজ্জনক ভাবে বাড়ছে। অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয় থেকে বাঁচার পন্থা হিসেবে বিশেষজ্ঞরা যে পদক্ষেপগুলি রাষ্ট্র এবং তার নাগরিকদের নিতে উপদেশ দিচ্ছেন, তা মেনে নিলে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় ব্যাপক এবং কঠোর পরিবর্তন আবশ্যিক। এদিকে, যারা প্রচার চালাচ্ছেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন ব্যাপারটা একটা ভাঁওতা, তাঁরা বলছেন, ‘ধুর, এসব বাজে কথা, ভিত্তিহীন। দেখতে পাচ্ছেন না এ বছর কী রেকর্ড-ভাঙা ঠান্ডা পড়েছে?’ এই যুক্তি শুনে, একটা বড় সংখ্যক মানুষের মধ্যে দোটানার সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ, হুট করে নিজের ‘কমফর্ট জোন’ থেকে বেরিয়ে না আসার একটা ছুতো আমাদের সামনে রুপোর থালায় সাজিয়ে পরিবেশন করা হচ্ছে। এখানে আত্মমুগ্ধতা না হলেও, আত্মসন্তুস্টি কাজ করছে। এবং, ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং একটি ধাপ্পাবাজি’- এই থিয়োরি প্রচারের কায়েমি স্বার্থটা যে কিছু দৈত্যাকার কর্পোরেট সংস্থাগুলোর, তাদের মালিক এবং সেই মালিকদের পকেটস্থ রাজনৈতিক নেতাদের, তাও কারও অজানা নয় আজকে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখার জন্য একটা কনস্পিরেসি থিয়োরিই যে যথেষ্ট, তা বোঝাতে পেরেছি আশা করি। নেতাজীর মৃত্যুকে ঘিরে একটা আরোপিত রহস্যের জাল বুনে চলার পিছনেও সেই একই ‘ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে’। নেতাজীর সমসাময়িক এক রাজনেতাকে তাঁর ‘চিরশত্রু’ এবং আমাদের দেশের ‘সুপার-ভিলেন’ প্রতিপন্ন করার জন্য এর থেকে ভাল ‘ফ্রেম-আপ’ আর হয় না যে। 


আজ স্বাধীনতার ৭২ বছর পর সারা দেশ জুড়ে এমন কোন শহর বা গ্রামাঞ্চল নেই যেখানে অন্তত একটা স্কুল, কলেজ, ক্লাব, রাস্তা, স্টেশন, লাইব্রেরি, স্ট্যাচু, কিংবা সরোবরের সঙ্গে নেতাজী’ কিংবা আজাদ হিন্দ’ কিংবা  জয় হিন্দ’ জড়িয়ে নেই! তার অর্থ কি এই যে নেতাজীর ভাবধারায় গোটা দেশ আজ উদ্বুদ্ধ?  গোটা দেশ নেতাজিময়তায় আপ্লুত?  সাইনবোর্ডে যাই লেখা থাক, আপনি এবং আমি, দুজনেই জানি যে, যেকোন জিনিষের বহুল ব্যবহারে যা হয়ে থাকে এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এক, নেতাজীকে নিয়ে এক বা একাধিক স্টিরিওটাইপ তৈরি হয়েছে। দুই, গোটা ব্যাপারটা ভাসা-ভাসা এবং অর্থহীন হয়ে গেছে। প্রথম বিষয়, স্টিরিওটাইপ, মানে একটা ‘সিংগল স্টোরি’-র বিপদ। মেক্সিকান মানেই ইললিগাল ইমিগ্রান্ট, মুসলমান মানেই উগ্রপন্থী, বৌদ্ধ মানেই অহিংস- এই ধরনের স্টিরিওটাইপ। আর এটা থেকেই জন্ম নিয়েছে দ্বিতীয় বিষয়- ‘নেতাজী’, ‘আজাদ হিন্দ’, ‘জয় হিন্দ’, এই সব শব্দগুলোর পটভূমিকা, প্রকৃত অর্থ, প্রয়োগ, তাৎপর্য এবং আজকের দিনে প্রাসঙ্গিকতা - সব হারিয়ে গেছে। এই ঘটনাটি, আমার মনে হয় একধরনের সামাজিক ‘semantic satiation’তার ওপর, দশকের পর দশক ধরে, বহু ঐতিহাসিক সত্যেরঅমিশনএবংসাপ্রেসন আজকের সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে এক মিথ্যার বেসাতির আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছে জন্ম নিচ্ছে ‘স্বঘোষিত’ নেতাজি-গবেষকের দল।জয় হচ্ছে ষড়যন্ত্রবাদের। ফলে, নেতাজীর কাজ, দেশগঠনের পরিকল্পনা নিয়ে চর্চা না করে মানুষ আজ মনোরঞ্জন খুঁজছে ভিত্তিহীন গসিপে সুস্থ সমাজ এবং রাজনীতিতে এ এক বিপজ্জনক এবং বিষাক্ত প্রবণতা। সেইদিন আর নেই, যখন ষড়যন্ত্রের গুজব বেচে খাওয়া লোকেদেরও, কিছু অর্ধসত্য কিংবা খন্ডচিত্রের প্রয়োজন হত। আজ গুজব রটাতে গেলে কেবল একটু সন্দেহ, একটু বিদ্বেষই যথেষ্ট।তাই, ভোলাকাকুদের মত ষড়যন্ত্র-ত্বত্ত্ব বিলাসীদের আজ স্বর্ণযুগ অতএব, গোঁজামিলের গালগল্পকে যদি বেঁধে ফেলা যায় টানটান চিত্রনাট্যে এবং অভিনয় করানো যায় তারকাদের দিয়ে, তাহলে তা শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য না হলেও, মুখরোচক তো হবেই সেই ছবি দেখে এক বৃহৎ সংখ্যক দর্শক ঘাড় নেড়ে বলবেন, কি জানি বাপু, হলেও তো হতে পারে! আর পরিচালক মুচকি হেসে বলবেন, ফুচকা যে হেলথ ফুড নয়, তা কি প্রমাণিত হয়েছে? এই লেখার শেষটাও তাই অনেকটা হযবরল-র অন্তিম প্যারাগ্রাফের মত আরেকবার পড়ে দেখুন, ঠিক বুঝতে পারবেন  

*****


Friday, August 16, 2019

পেনসি লা-র সেই রাত


এই লেখাটি গত ১১ই আগস্ট, ২০১৯, সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল 'তারার গ্রাসে মোড়া তুষারতীর্থ' নামে। নীচের লেখাটি পড়ার আগে কাকাবাবুর সঙ্গে অমরনাথে  পড়ে নিলে এই  গল্পটা বুঝতে একটু সুবিধা হবে। 


আমাদের ছোটবেলায় একটা সিনেমা এসেছিল, ‘তুষারতীর্থ অমরনাথ’। সেই থেকে, কেন জানিনা, অমরনাথ নামটা শুনলেই সবকিছুর আগে আমার আজও সেই ছায়াছবির কথাই মনে পড়ে। এমনকি অমরনাথ নামের কোনও ভদ্রলোকের সঙ্গে কোথাও আলাপ হলেই, মনে মনে তার নামের আগে প্রিফিক্স হিসেবে ‘তুষারতীর্থ’ তৎক্ষণাৎ বসিয়ে দেবার একটা বিচ্ছিরি অভ্যেসও আজকাল দেখা দিয়েছে। তবে যেহেতু, এই উপাধী দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ব্যাপারটা সাধারণত ঘটে আমার মনের মধ্যে, তাই প্রত্যেকবারই অপ্রস্তুত হওয়া থেকে আমি এবং সেই ব্যক্তি-দুজনেই বেঁচে যাই। নস্টালজিয়া যে সময় বিশেষে মানুষকে নষ্ট, থুড়ি, ননসেন্সিকাল করে দিতে পারে তার চলমান প্রমাণ আমি নিজেই। অথচ অমরনাথ যাত্রা বলতে আজকাল যেটা বোঝায় সেটা কিন্তু আমার জীবনে একবারই ঘটেছিল, তাও পাক্কা তিরিশ বছর আগে, আমার কাকাবাবুর সঙ্গে।

বাংলা সাহিত্য এবং সিনেমায়, তীর্থযাত্রা এবং তার পুণ্যলোভাতুর যাত্রী বলতে ঠিক যে ছবিগুলো আঁকা রয়েছে, তার কোনও ছাঁচেই আমি কাকাবাবুকে কোনদিন ফেলতে পারিনি। আমার বয়স তখন সদ্য আঠারো। পায়ে হান্টার জুতো আর পিঠে রুকস্যাক নিয়ে মাউন্টেনিয়ার কাকাবাবুর সঙ্গে হিমালয়ে গিয়েছিলাম আমি সময়টা ভাবুন একবার! বাড়ি ছাড়ার পর থেকেই আড় চোখে লক্ষ্য করছিলাম কাকাবাবুর রুকস্যাক পিঠে হাঁটার স্টাইল। অনুকরণও করছিলাম হুবহু। কাকাবাবু যা বলছিলেন, তা গিলছিলাম গোগ্রাসে। কখনও ডাল লেকের পাড়ে বসে ভেড়ার মাংসের শিক কাবাবে কামড় দিয়ে শুনছিলাম সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে কাশ্মীরে তাবাক-মাজ চলে আসার খুশবুদার গল্প আবার কখনও লিডার নদীর ধারে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম, স্যার জন হান্টের কোলাহোই শৃঙ্গে ব্যর্থ অভিযানের খুঁটিনাটি অমরনাথ গুহার পথে যত এগিয়েছিলাম, এরিক শিপটন এর অভিযান, গুলোল গলি গিরিপথ পার হয়ে কাকাবাবুদের জান্সকার ট্রেক করার মতলব, আর চন্দনওয়াড়ির ঘোড়াওয়ালা মকবুল চাচার অট্টহাসি কোথায় যেন মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল কখনও পুরনো গল্পের আমেজে, কখনও হাঁটার সময় নতুন বন্ধু পাবার রোমাঞ্চে, আমি এক নতুন জীবন দর্শন পেয়েছিলাম হিমালয়ের আত্মা যে কেবল দেবতাদের জন্য সংরক্ষিত নয় তা হয়ে উঠেছিল ক্রমশ সুস্পষ্ট

আজ বুঝতে পারি, সেবারেই, হিমালয় অভিযানের ইতিহাস এবং তাকে বারবার নতুন করে আবিষ্কারের এক রোমাঞ্চময় ঠিকানার খোঁজ পেয়েছিলাম আমি। সেই আবিষ্কারের আনন্দে ম্লান হয়ে গিয়েছিল তীর্থপথের ধুপ-ধুনো, খোল-কর্তাল, জয়ধ্বনি এবং ভক্তির বন্যা। হাজারে হাজারে তীর্থযাত্রীর, মন্ত্রমুগ্ধের মত, পুণ্য নামের কোন এক অজানা বস্তুর লোভে পাহাড়ি পথ ভাঙা এবং গুহার মধ্যে এক বিশাল আইস-স্ট্যালাগমাইটের সামনে তাদের সাষ্টাঙ্গ প্রনাম, আলাদা করে আমার মনে কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি। তাই, সেবার পহলগাম, চন্দনওয়াড়ি, শেষনাগ, মহাগুনাস টপ, পঞ্চতরনী হয়ে অমরনাথ গুহার পথ কোথা দিয়ে যে কেটে গিয়েছিল, তা টেরও পাইনি। এই ঘটনার প্রায় দুদশক পরে আরও একবার গিয়েছিলাম কাশ্মীর। কাকাবাবু তখন আর বেঁচে নেই। তবে পিঠে রুকস্যাক এবং পাশে আমার বন্ধু আব্বাস থাকলেও, কাকাবাবু মনের মধ্যেই ছিলেন সেটা ছিল দুই বাল্যবন্ধুর শু-স্ট্রিং বাজেটের এক ব্যাকপ্যাকিং ট্রিপ।


শ্রীনগর থেকে গুলমার্গ, দুরত্ব বেশী না হলেও, পৌঁছতে সারাদিন লেগে গিয়েছিল। একটি আর্মি ট্রাক এবং যাত্রীবাহী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের জেরে প্রায় সারাদিন আমরা আটকে ছিলাম রাজপথে। গুলমার্গ পৌঁছে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা গেছিল। পরদিন ভোররাতে ফজরের আজানের ডাকে ঘুম ভেঙেছিল। সারাদিন ঘুরে বেরিয়েছিলাম গুলমার্গের বিখ্যাত স্কি রিসর্টের আশেপাশে। গ্রীষ্মের স্কি রিসর্টে সবুজের গালিচা মুড়ে রেখেছিল চারদিকের পাহাড়ের ঢাল। বরফ না থাকলেও স্কি লিফটটা চলছিল। আমরা দুজনে সেই লিফটে চেপে বেশ কিছুটা উঁচুতে উঠে দেখতে চেষ্টা করেছিলাম ‘কিলার মাউন্টেন’ নাঙ্গা পর্বতকে। সেই নাঙ্গা পর্বত, যাকে ১৯৫৩ সালে, একা আরোহণ করে ফেরার সময় সারারাত একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে কাটিয়েছিলেন প্রবাদ প্রতিম অস্ট্রিয়ান অভিযাত্রী হারমান বুল। সেই নাঙ্গা পর্বত, যেখানে  হালে, ২০০৫ সালে, বিখ্যাত স্লোভেনিয়ান ক্লাইম্বার টোমাজ হুমার অ্যাভালাঞ্চে আটকে পড়েও, বেঁচে ফিরেছিলেন ৬ দিন নিখোঁজ থাকার পরসকালের দিকে একটা মন খারাপ করা কুয়াসা ছিল। একটু বেলার দিকে, অনেকটা যেন আমাদের আশা মেটাতেই, মেঘের স্তরের অনেক ওপরে অনেকটা স্বপ্নের মত দেখা দিয়েছিল নাঙ্গা পর্বত, যার আর এক নাম দিয়ামির। আমায় একেবারে অবাক করে দিয়ে আব্বাস জানিয়েছিল, ডিসি কমিকসের ইউনিভার্সেও নাকি এই নাঙ্গা পর্বত অনুপ্রাণিত এক কাল্পনিক শহর রয়েছে। সেখানে তার নাম অবশ্য ‘নান্দা’ পর্বত, আর সেই শহরে পৌছতে গেলে প্রয়োজন হয় এক অদৃশ্য মানচিত্রের

পরদিন দুজনে সোনামার্গ পৌঁছনোর পর, অদৃশ্য নয়, দৃশ্যমান পকেট মানচিত্র নিয়েই হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। লক্ষ্য ছিল থাজিওয়াস গ্লেসিয়ার। পুরনো এক পাহাড়ি জার্নালে পড়েছিলাম, ১৯৩৩ এর জুন মাসে, জন্সটন, হ্যারিসন এবং ওয়াটস নামের তিন ব্রিটিশ অভিযাত্রীর এই থাজিওয়াস হিমবাহে অ্যাডভেঞ্চারের কথা। থাজিওয়াস উপত্যকাকে তাঁরা উল্লেখ করেছিলেন ‘ভ্যালি অফ গ্লেসিয়ার্স’- ‘হিমবাহের উপত্যকা’ নামে। ওয়াটস লিখেছিলেন, ক্লাইম্বিং এর নির্মল আনন্দ ছাড়াও এই উপত্যকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের কোনও তুলনাই নেই। আমি আর আব্বাস যেদিন থাজিওয়াস পৌঁছেছিলাম, ঘটনাচক্রে সেটাও ছিল জুন মাসঘোড়ার পিঠে সওয়ার কয়েকশো টুরিস্টের ভিড় এবং অগণিত ক্যাম্প পার হয়ে পথের শেষে পৌঁছে ‘ভ্যালি অফ গ্লেসিয়ার্স’ এর বর্তমান হালত দেখে মন ফুরফুরে হবার বদলে বেশ দমে গিয়েছিল। প্লাস্টিকের বোতল আর চিপসের প্যাকেটের স্তুপ পাশে রেখে নির্লিপ্ত উল্লাসে ছবি তুলে চলেছিল দলে দলে ভারতীয় পরিবার। দুজনেই একটা বিষয়ে সেদিন একমত হয়েছিলাম- ঠিক এখানেই যদি একটা মন্দির বা মসজিদ থাকত, তাহলে হয়ত জায়গাটা এতটা নোংরা হত না। ভুত কিংবা ভগবান- এই দুজনের কেউ একজন মাথার ওপর ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে ভয় না দেখালে, ভারতবাসীর শখের প্রাণ আসলে ধাপার মাঠ

পরদিন রাস্তায় অমরনাথ যাত্রার প্রবল যানজটে বেশ কয়েকঘন্টা আটকে থাকার পর আমাদের গাড়ি ধরেছিল জোজি-লার রাস্তা একের পর এক হেয়ার-পিন বেন্ড এবং আরও বেয়াড়া ধরণের কিছু সুইচ-ব্যাক পার হয়ে অবশেষে পৌঁছেছিলাম ঐতিহাসিক গিরিপথ জোজি-লার মাথায়। কোথায় যেন পড়েছিলাম যে, ১১৭৫০ ফুট উচ্চতায় জোজি-লাই হল গ্রেট হিমালয় রেঞ্জের সবথেকে নিচু গিরিপথ। জোজি-লায় জিওলজি এত ক্ষমাশীল কেন, তা মাথায় না ঢুকলেও, ইতিহাস বলছিল, এই জোজি-লাতেই  বিশ্বের উচ্চতম ট্যাঙ্ক যুদ্ধের রেকর্ড গড়ে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের সেনাকে নাস্তানাবুদ করে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল ভারতীয় সেনা। ১৯৩৮ সালে এই পথ ধরেই কে-টু অভিযানে গিয়েছিলেন চার্লি হাউস্টন সহ অন্য মার্কিন অভিযাত্রীরা এবং তারও সাতশো বছর আগে এক বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে ভারতে প্রবেশের পথ নিজের চোখে দেখতে এসেছিলেন চেঙ্গিস খান। কারগিল যুদ্ধের ছায়াপথ ধরে এসেছিল দ্রাস, টুলুলিং সন্ধের আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম কারগিল বালটি বাজারের গলিতে ঠেলাগাড়িতে বিক্রি হচ্ছিল কাবাব অবাক লাগছিল এই ভেবে যে, লাইন অফ কন্ট্রোল খুব কাছেই এবং সবসময় দুইদেশের কয়েকশো চোখ এবং বন্দুক তাক করে আছে একে অপরের দিকে কিছু মানুষের অঙ্গুলিহেলনে আকস্মিকভাবেই সবকিছু বদলে যেতে পারে একটা অস্বস্তিকর ভ্যাপসা গরম হাওয়া উঠে আসছিল সুরু নদীর বুক থেকেসময় নষ্ট না করে আমরা দুই বন্ধু সস্তার একটা হোটেল খুঁজেছিলাম আর ভেবেছিলাম হয়ত কোনদিন আনন্দ ছিল এ শহরে।


পরদিন সাতসকালে ব্যাগ-বস্তা পিঠে নিয়ে দুজনে বাজারে এসে দাঁড়াতেই অযাচিত ভাবেই লিফট পেয়েছিলাম জান্সকার গামী এক ভদ্রলোকের গাড়িতে। ভদ্রলোক জান্সকারি, নাম বলেছিলেন রিগজিন। বলেছিলেন, একাই ফিরতাম পদম, ভালই হল দুজন সঙ্গী জুটল পথের। দুজন মিলে যা ইচ্ছে দিও। রংদুম গোম্পা পার হবার পর পেনসি লার মাথায় পোঁছতে কিছুক্ষনের জন্য থেমেছিল রিগজিনের গাড়ি। আমরা দুজন হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম দ্রাং দ্রুং হিমবাহের বিস্তার। চোখের সামনে তেইশ কিলোমিটার জুড়ে শুয়ে ছিল এক অপূর্ব সুন্দর হিমবাহ। হিমবাহের শেষপ্রান্তে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল ডোডা শৃঙ্গ। কয়েক মিনিট লেগেছিল মনস্থির করতে।

সেদিন পদম যাবার সিদ্ধান্ত বদলে রিগজিনকে ধন্যবাদ এবং বিদায় জানিয়ে নিজেদের স্যাক গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়েছিলাম আমরা। গাড়ির রাস্তা থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে লাগিয়েছিলাম বয়ে আনা ছোট তাঁবু। বিকেল গড়িয়ে কখন যে সন্ধ্যা নেমেছিল আমরা বুঝতেই পারিনি। প্রকৃতির মন্ত্রে মুগ্ধ তখন আমরা দুজন। তারায় ভরে উঠেছিল সেই রাতের আকাশ- ঠিক যেন কবির ভাষায় ‘স্টার ইটেন ব্ল্যাংকেট অফ দি স্কাই’। তারার আলোয় এক অদ্ভুত মায়াবী ছায়াছবি ফুটে উঠেছিল দ্রাং দ্রুং হিমবাহের অবয়ব জুড়ে সেই মুহুর্তে বিশ্বের সমস্ত মন্দির, মসজিদ, গোম্পা, কিংবা গির্জার স্থাপত্য-ভাস্কর্য্য এবং আরোপিত মাহাত্ম্য তার কাছে তাৎপর্য হারিয়েছিল। তার দিকে আমরা নিবিষ্ট হয়ে চেয়েছিলাম। চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। খেটেখুটে তৈরি করা কফি কখন ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল কেউ টের পাইনি। পরদিন সকালে দ্রাং দ্রুং হিমবাহের সামনে ‘তুষারতীর্থ’ প্রিফিক্স হিসেবে জুড়ে দিতে তাই একটুও দ্বিধা হয়নি।
-------------------              
      

Tuesday, August 6, 2019

কাকাবাবুর সঙ্গে অমরনাথে


এই লেখাটি 'প্রতিদিন রোববার' পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ তে ছাপা হয়েছিল।  সম্পাদকের অনুমতি নিয়ে আমার ব্লগে দিলাম। 

কাকাবাবুর সঙ্গে অমরনাথে 

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়

পুণ্যের কথাই যখন উঠল, তখন প্রথমেই বলা দরকার পাপের কথা। পাপ যে বেশ বিষাক্ত বস্তু, তা দেবদ্বিজে ভক্তি রাখা বাঙালি মাত্রেই জানেন।সেই বিষের অ্যান্টিডোট যে পুণ্য, তাও কারও অজানা নেই। আর জানা আছে বলেই সবাই সেটা চায়, কারন পাপের ভাগীদার, তা সে বাপেরই হোক বা নিজের; হতে কেউ চায় না। এদিকে পাপের পাশ কাটিয়ে পালানোর পথ নেই, কারন ঠাকুর যখন-তখন, যাকে-তাকে পাপ দেন। তাই সেই পাপের উল্টোটা, অর্থাৎ কিনা পুণ্যকে আমরা এতটাই চাই যে, আমাদের লোভ হয়।পুন্যলোভাতুর শব্দটি নিজেই সেই ঘটনার রাজসাক্ষী কিন্তু যেহেতু, বলা আছে, লোভে পাপ এবং পাপে মৃত্যু; তাই পুণ্য লাভ করতে গিয়ে যেই আমরা একটু লোভ করি, ওমনি আবার আমরা সেই পাপের ফাঁদেই পা দিই। ওপর থেকে ঠাকুর হাততালি দিয়ে খিল খিল করে হাসেন। তাঁর বালক স্বভাব যে!


পুণ্য অর্জন আমার জন্মসিদ্ধ অধিকার; কিংবা মনুষ্য জীবনে পুন্যলাভের বিশেষ প্রয়োজন আছে কি নেই এইসব গুরুতর ত্বত্ত্ব বুঝে ওঠার অনেক আগেই আমার পুণ্যভূমি অমরনাথ যাত্রা হয়েছিল অমরনাথ যাত্রাকথাটা তখনও এত বহুল প্রচারিত হয়নি লোকজন অমরনাথ যাচ্ছিকিংবা একটু অমরনাথটা ঘুরে আসিবলেই বাড়ি থেকে বের হত আমার সেই ঘুরে আসাহয়েছিল আজ থেকে তিরিশ বছর আগে, আমার কাকাবাবুর হাত ধরে আঠারো বছরের এক সদ্য যুবকের কাছে সে ছিল এক দুর্বার অ্যাডভেঞ্চার পিঠে রুকস্যাক, পায়ে হান্টার জুতো আর গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে যখন হিমগিরি এক্সপ্রেস থেকে জম্মু স্টেশনে নেমেছিলাম তখন নিজেকে সন্তুর থেকে কোন অংশে কম মনে হয়নিকারন, আপাত দৃষ্টিতে অ্যাভারেজ হাইট বাঙালি হলেও, আমার কাছে অ্যাডভেঞ্চারের বাস্তব মাপকাঠিতে কাকাবাবু ছিলেন একজন হিরো ষাটের দশকের দোরগোড়ায় যেকজন হাতে গোনা বাঙালি তেনজিং নোরগে শেরপার কাছে হাতে কলমে পাহাড়ে চড়া শিখেছিলেন, আমার এই কাকাবাবু ছিলেন তাঁদের একজন ১৯৮৮ তে, ৫৬ বছর বয়সেও, কাকাবাবুর ছিল এক পেটানো মজবুত চেহারা আর মুখে সর্বদাই লেগে থাকত এক কৌতূহলী শিশুর ছটফটে সারল্য ফলে নিজেকে ভাইপো কম, বরং কাকাবাবুর অ্যাডভেঞ্চার সঙ্গী বেশী মনে হত আমার বরাবরই


জম্মু থেকে শ্রীনগর বাসে বসেই কাকাবাবুর উত্তেজনার আঁচ আমার গায়ে লেগেছিল সেই উত্তেজনা ছিল ডাল লেকের পাড়ে বসে ভেড়ার মাংসের শিক কাবাব খাওয়ার সত্যি কথা বলতে কি, শিক কাবাব ব্যাপারটা আমি সেই প্রথম শুনি আজ ভাবতে অবাক লাগে, শহরতলীতে বড় হয়ে ওঠা একজন কিশোরের কাছে এতটাই অনাবিষ্কৃত ছিল খাদ্যের ভূগোল, এই কিছুদিন আগেও পরদিন সত্যিই ডালের পাড়ে কাশ্মিরি শিক কাবাব খাইয়েছিলেন কাকাবাবু আর গল্প বলেছিলেন পহলগামে তাঁর বন্ধু মকবুলের বাড়ি একবার কেমন আয়েস করে ‘তাবাক মাজ’ খেয়েছিলেন।‘তাবাক মাজের’ রেসিপি সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে এই কাশ্মীরে এসেছিল, জানিস তো? বলেছিলেন কাকাবাবু। ডাল লেকে সন্ধে নেমেছিল। পাতলা কুয়াসা ভেদ করে শিরশিরে ঠান্ডার আমেজে হাঁটতে হাঁটতে হোটেল ফেরার পথে মনে হয়েছিল বড় হয়ে একবার মধ্য এশিয়া যেতেই হবে। সমরখন্দের বাজারে না জানি আরও কত গল্পের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে কাকাবাবুর বন্ধুরা।


পরদিন পহলগাম পৌঁছতেই কাকাবাবুর মধ্যে যেন এক অন্য উত্তেজনা লক্ষ্য করছিলাম আমি। বিকেলে লিডার নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে পেরেছিলাম কাকাবাবুর সেই উত্তেজনার উৎস আসলে কী! কাকাবাবু বলেছিলেন, জানিস এই লিডার নদীর উৎস মূলত কোলাহোই বলে একটা পাহাড়ের গ্লেসিয়ার? আমার সেকথা জানার তখন কথা নয়, তবু বিস্ময়ে হাঁ করে কাকাবাবুর কথা গিলেছিলাম। ১৯৩৫-এ এরিক শিপটন নেপাল থেকে মাউন্ট এভারেস্টে ওঠার পথ প্রায় খুঁজে বার করে ফেলেছেন আর সেই বছরই জুলাই মাসের ৯ তারিখে দুই ইংরেজ অভিযাত্রী এই পহলগামে এসে পৌঁছেছিলেন। কেন জানিস? কোলাহোই পাহাড় ক্লাইম্ব করার জন্য। উচ্চতায় আঠারো হাজার ফুটও নয় তবু এই কোলাহোই পিক সেই সাহেব দুজন সেবার ক্লাইম্ব করতে পারেননি। যদিও কোলাহইয়ের গা থেকে অদূর দিগন্তে নাংগা পর্বত দেখে তাঁদের বেজায় ফুর্তি হয়েছিল। এই দুজনের একজনই পরবর্তী কালের প্রথম সফল এভারেস্ট অভিযানের দলনেতা স্যার জন হান্ট। পাহাড় ছোট হলেই কি আর সহজ হয়ে যায় রে? আর পাহাড়ের মাথায় উঠে দাঁড়ানোটাই পাহাড় চড়ার শেষ কথা নয়, বলেই কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন কাকাবাবু। ‘এটাও জুলাই মাস’, এই কথাটা সেদিন  কাকাবাবুকে একবার বলতে গিয়েও চুপ করে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল সব কিছুর মধ্যে সংযোগ টেনে আনা এক একসময় একেবারেই কাজের কথা নয়তার চেয়ে লিডার নদীর গান আর দুরের দিগন্তে বরফের আভাষে চোখ রাখা ঢের ভাল।


মকবুল চাচার সঙ্গে দেখা হয়েছিল দুদিন পর চন্দনওয়াড়িতে। তখন জানতে পেরেছিলাম মকবুল চাচা আসলে একপাল ঘোড়ার মালিক। এই তীর্থযাত্রার সিজনে তাঁর ব্যস্ততার শেষ নেই। সেই প্রথম দেখেছিলাম, পুণ্যলোভাতুর যদি অর্থশালী হন, তখন পুণ্য লাভ করতে বিশেষ ক্রিচ্ছসাধন করতে হয় না। কারণ, ‘ফেল কড়ি মাখ তেল’ উপপাদ্য ঈশ্বরের সদর দফতরেও কাজ করে। আর সেখানেই মকবুল চাচা অম্লান বদনে বাহন সাপ্লাই দেন। ঘোড়া ভাড়া নিয়ে প্রবল দরদস্তুর এবং হাঁকডাকের    মধ্যেই কাকাবাবুকে দেখে একগাল হেসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মকবুল চাচা। বছর খানেক আগে এক এক্সপিডিসনে এসে নাকি ওদের দুজনের প্রথম আলাপ হয়েছিল এই নিয়ে সবে যে তাঁদের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ, সেই বুকে জড়িয়ে ধরা দেখে বোঝার উপায় ছিল না। আমাকে দেখে মকবুল চাচা বলেছিলেন, ভাতিজা হ্যায় না? মেরে পাস ছোড় কে জাও জি। ম্যায় ঘুমাউংগা উসকো। কাকাবাবু হেসেছিলেন হা হা করে। পাহাড়ি মানুষের বন্ধুত্ব কীরকম জবরদস্ত হয় সেদিন অল্প হলেও বুঝেছিলাম।  

                        
চন্দনওয়াড়ি থেকেই অমরনাথের হাঁটা শুরুপরদিন সকালে উঠেই দেখি শয়ে শয়ে মানুষ পথে নেমেছে। কাকাবাবু বললেন, আমরা একদিন এখানেই থাকব, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াব, লঙ্গরে খাব। প্রায় সাড়ে ন’হাজার ফুট হাইট এখানকার, তাই উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে খাপ খাওয়াবো।এই যে এত লোক অসুস্থ হয়ে পড়ছে দেখতে পাচ্ছিস তার বেশির ভাগই অল্টিচিউড সিকনেসের জন্য। কিন্তু কে এদের বোঝাবে যে বাতাসে অক্সিজেন কমে গেলে পাপ-পুণ্য ম্যাটার করে না, সব স্রেফ শুন্য হয়ে যায়। শিব ঠাকুর তো হাই অল্টিচিউডেই থাকেন, তাই তাঁর না হয় আলাদা করে অ্যাক্লাইমেটাইজেসনের দরকার হয় না।কিন্তু ভক্তদের যা অ্যাটিচিউড সেখানে অল্টিচিউড প্রসঙ্গ না আনাই শ্রেয়তুই বরং মানুষ দ্যাখ। ভারতের সব প্রান্ত থেকে আসা অগণিত মানুষ। একবার ভাব তো, ভারতবর্ষের মানুষ নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-মারপিট না করে কেমন শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে, কষ্ট সহ্য করে পথ চলেছে! ঠিক যেন কেউ এদের হিপনোটাইজ করে রেখেছে, তাই না? ঠিক যেন ইন্দ্রজাল। কিন্তু প্রশ্ন হল এখানকার যাদুকরটি কে এবং কোথায়? তিনি কি ঐ গুহাতেই বাস করেন? তাও বছরে এই এক-দুই মাসের জন্য? কাকাবাবুর কথার অর্ধেক আমার মাথায় ঢোকে না, তবু ঘাড় নাড়ি। ম্যাজিক দেখতে কার না ভাল লাগে। কাকাবাবুকে সে রাতে একটু ডিস্টার্বড দেখায়।  


পরদিন পিসু টপ পার হয়ে শেষনাগ ক্যাম্পে পৌঁছে নিজেদের রাতের আশ্রয় জোগাড় হয়ে যেতেই দুজনে আবার ঘুরে বেড়াই। এক দোকানে বসে চা খেতে গিয়ে দেখি একজন পথ চলেছে খালি পায়ে, তার পায়ের ধুলো নেবার জন্যও আবার কিছু লোকও জুটে গেছে। আজ রাতে সে নাকি শেষনাগেই থাকবে।আমি তার ক্ষতবিক্ষত পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকি। তার কাছে গিয়ে কাকাবাবু গলা নামিয়ে জিগ্যেস করে, নাম কেয়া হ্যায় আপকা? উত্তর আসে, চেতন। একটা বিটাডিন মলমের ছোট টিউব চেতনের হাতে ধরিয়ে কাকাবাবু বলে চলেন, আউর কুছ দাওয়াই চাহিয়ে তো মাঙ্গ লেনা। খালি পায়ের তীর্থযাত্রী কোন উত্তর দেয় না। আমরা চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে আসি। আমাকে কিছুটা বিচলিত দেখেই বোধহয় কাকাবাবু বলতে থাকেন, নব্বই বছর আগে অর্থাৎ, ১৮৯৮ সালে স্বামী বিবেকানন্দ এবং নিবেদিতা এই পথেই অমরনাথ দর্শনে গিয়েছিলেনআর সম্ভবত পিসু টপ খালি পায়ে পার হয়েছিলেন। চোখের সামনে ক্ষতবিক্ষত খালি পায়ের এক অজ্ঞাত যাত্রীকে দেখার পর বিবেকানন্দের উদাহরণ আমার ওপর বিশেষ কোন ছাপ ফেলতে পারছে না দেখেই সম্ভবত কাকাবাবু কথা ঘোরালেন। পূর্ব দিকের বরফ ঢাকা পাহাড়ের ঢাল দেখিয়ে কাকাবাবু বলেন, ঐ ঢাল বেয়ে একটা পাসে ওঠা যায় বুঝলি? পাস-টার নাম গুলোল গলি।আসছে বছর ঐ পথে একটা ট্রেক করব আমরা কয়েকজন। গুলোল গলি পেরিয়ে পৌঁছে যাব রঙ্গমার্গ তারপর হামপেট, কানিতাল হয়ে সেই পানিখার। কাশ্মীর থেকে জান্সকার পৌঁছে যাব পাঁচদিনের মাথায়-বুঝলি কিছু? বুঝলাম কচু, তবু ঘাড় নাড়লাম ঢের। পরদিন মহাগুনাস টপ পার হয়ে পৌঁছে গেলাম পঞ্চতরনী, আর তার পরদিন অমরনাথ গুহা দেখে বাতাল


প্রবোধ কুমার সান্যাল তাঁর ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ বইতে লিখেছিলেন, ‘যারা তীর্থের পর তীর্থ পর্যটন করে বেড়ায়, তাদের মধ্যে আছে কেবল আত্ম-তাড়না, তারা দেবতার পিছনে পিছনে ছোটে, দেবত্বের স্পর্শ পায় না’। হিমালয়ের অন্দরমহলের খোঁজখবর তিরিশ বছর আগে আমার কাছে ছিল না, তাই কাকাবাবুর অনেক কথাই সেদিন বুঝি নি। তবে আজ বুঝি তীর্থের তাড়নায়, পর্বত অভিযানের অছিলায়, এমনকি নিছক ভ্রমনের বাতিকে যারা হিমালয়ে যান তাদের বেশিরভাগই সেই অন্দরমহলের খোঁজ রাখেন না। কাকাবাবু রাখতেন। মকবুল আর চেতন সে কথার সাক্ষী। আজ মনে হয়, সেই মকবুল চাচা আর চেতনের জন্যই আমি আমার কাকাবাবুকে চিনতে পেরেছিলাম। আমার জীবন একটি দর্শন পেয়েছিল। আর সেই জন্যই অমরনাথ আমার কাছে পুণ্যভূমি। একটি ওভারসাইজড আইস স্ট্যালাগমাইট এখানে নিমিত্ত মাত্র।   
-------------------------------------------------------------------

Discovering Ladakh’s Uncharted Petroglyphs : A Short Note

  Whispers on Stone: Discovering Ladakh’s Uncharted Petroglyphs We were trudging down a dusty trail by the frozen stream near the little v...