কাকাবাবুর সঙ্গে অমরনাথে
এই লেখাটি 'প্রতিদিন রোববার' পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ তে ছাপা হয়েছিল। সম্পাদকের অনুমতি নিয়ে আমার ব্লগে দিলাম।
কাকাবাবুর সঙ্গে অমরনাথে
অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
পুণ্যের কথাই যখন উঠল, তখন প্রথমেই বলা দরকার পাপের কথা। পাপ যে বেশ বিষাক্ত
বস্তু, তা দেবদ্বিজে ভক্তি রাখা বাঙালি মাত্রেই জানেন।সেই বিষের অ্যান্টিডোট যে
পুণ্য, তাও কারও অজানা নেই। আর জানা আছে বলেই সবাই সেটা চায়, কারন পাপের ভাগীদার,
তা সে বাপেরই হোক বা নিজের; হতে কেউ চায় না। এদিকে পাপের পাশ কাটিয়ে পালানোর পথ
নেই, কারন ঠাকুর যখন-তখন, যাকে-তাকে পাপ দেন। তাই সেই পাপের উল্টোটা, অর্থাৎ কিনা
পুণ্যকে আমরা এতটাই চাই যে, আমাদের লোভ হয়।পুন্যলোভাতুর শব্দটি নিজেই সেই ঘটনার রাজসাক্ষী। কিন্তু যেহেতু, বলা আছে, লোভে পাপ এবং পাপে মৃত্যু; তাই পুণ্য লাভ করতে গিয়ে যেই
আমরা একটু লোভ করি, ওমনি আবার আমরা সেই পাপের ফাঁদেই পা দিই। ওপর থেকে ঠাকুর
হাততালি দিয়ে খিল খিল করে হাসেন। তাঁর বালক স্বভাব যে!
পুণ্য অর্জন আমার জন্মসিদ্ধ
অধিকার; কিংবা মনুষ্য জীবনে পুন্যলাভের বিশেষ প্রয়োজন
আছে কি নেই এইসব গুরুতর ত্বত্ত্ব বুঝে ওঠার অনেক আগেই আমার পুণ্যভূমি অমরনাথ যাত্রা
হয়েছিল। ‘অমরনাথ যাত্রা’ কথাটা তখনও
এত বহুল প্রচারিত হয়নি। লোকজন ‘অমরনাথ যাচ্ছি’ কিংবা ‘একটু অমরনাথটা ঘুরে আসি’ বলেই বাড়ি থেকে বের হত। আমার সেই ‘ঘুরে
আসা’ হয়েছিল আজ থেকে তিরিশ বছর আগে, আমার
কাকাবাবুর হাত ধরে। আঠারো বছরের এক সদ্য
যুবকের কাছে সে ছিল এক দুর্বার অ্যাডভেঞ্চার। পিঠে রুকস্যাক, পায়ে হান্টার জুতো আর গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে যখন
হিমগিরি এক্সপ্রেস থেকে জম্মু স্টেশনে নেমেছিলাম তখন নিজেকে সন্তুর থেকে কোন অংশে কম
মনে হয়নি।কারন, আপাত দৃষ্টিতে অ্যাভারেজ হাইট বাঙালি হলেও,
আমার কাছে অ্যাডভেঞ্চারের বাস্তব মাপকাঠিতে কাকাবাবু ছিলেন একজন হিরো। ষাটের দশকের দোরগোড়ায় যেকজন হাতে গোনা বাঙালি তেনজিং নোরগে শেরপার
কাছে হাতে কলমে পাহাড়ে চড়া শিখেছিলেন, আমার এই কাকাবাবু ছিলেন তাঁদের একজন। ১৯৮৮ তে, ৫৬
বছর বয়সেও, কাকাবাবুর ছিল এক পেটানো মজবুত চেহারা আর মুখে সর্বদাই
লেগে থাকত এক কৌতূহলী শিশুর ছটফটে সারল্য। ফলে নিজেকে ভাইপো কম, বরং কাকাবাবুর অ্যাডভেঞ্চার সঙ্গী বেশী মনে হত আমার বরাবরই।
জম্মু থেকে শ্রীনগর বাসে
বসেই কাকাবাবুর উত্তেজনার আঁচ আমার গায়ে লেগেছিল। সেই উত্তেজনা ছিল ডাল লেকের পাড়ে বসে ভেড়ার মাংসের শিক কাবাব
খাওয়ার। সত্যি কথা বলতে কি, শিক কাবাব ব্যাপারটা আমি সেই প্রথম শুনি। আজ ভাবতে অবাক লাগে, শহরতলীতে বড় হয়ে ওঠা একজন কিশোরের কাছে এতটাই অনাবিষ্কৃত ছিল খাদ্যের ভূগোল,
এই কিছুদিন আগেও। পরদিন সত্যিই ডালের
পাড়ে কাশ্মিরি শিক কাবাব খাইয়েছিলেন কাকাবাবু আর গল্প বলেছিলেন পহলগামে তাঁর বন্ধু
মকবুলের বাড়ি একবার কেমন আয়েস করে ‘তাবাক মাজ’ খেয়েছিলেন।‘তাবাক মাজের’ রেসিপি
সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে এই কাশ্মীরে এসেছিল, জানিস তো? বলেছিলেন কাকাবাবু। ডাল লেকে
সন্ধে নেমেছিল। পাতলা কুয়াসা ভেদ করে শিরশিরে ঠান্ডার আমেজে হাঁটতে হাঁটতে হোটেল
ফেরার পথে মনে হয়েছিল বড় হয়ে একবার মধ্য এশিয়া যেতেই হবে। সমরখন্দের বাজারে না
জানি আরও কত গল্পের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে কাকাবাবুর বন্ধুরা।
পরদিন পহলগাম পৌঁছতেই
কাকাবাবুর মধ্যে যেন এক অন্য উত্তেজনা লক্ষ্য করছিলাম আমি। বিকেলে লিডার নদীর পাড়ে
দাঁড়িয়ে বুঝতে পেরেছিলাম কাকাবাবুর সেই উত্তেজনার উৎস আসলে কী! কাকাবাবু বলেছিলেন,
জানিস এই লিডার নদীর উৎস মূলত কোলাহোই বলে একটা পাহাড়ের গ্লেসিয়ার? আমার সেকথা
জানার তখন কথা নয়, তবু বিস্ময়ে হাঁ করে কাকাবাবুর কথা গিলেছিলাম। ১৯৩৫-এ এরিক
শিপটন নেপাল থেকে মাউন্ট এভারেস্টে ওঠার পথ প্রায় খুঁজে বার করে ফেলেছেন আর সেই
বছরই জুলাই মাসের ৯ তারিখে দুই ইংরেজ অভিযাত্রী এই পহলগামে এসে পৌঁছেছিলেন। কেন
জানিস? কোলাহোই পাহাড় ক্লাইম্ব করার জন্য। উচ্চতায় আঠারো হাজার ফুটও নয় তবু এই
কোলাহোই পিক সেই সাহেব দুজন সেবার ক্লাইম্ব করতে পারেননি। যদিও কোলাহইয়ের গা থেকে
অদূর দিগন্তে নাংগা পর্বত দেখে তাঁদের বেজায় ফুর্তি হয়েছিল। এই দুজনের একজনই
পরবর্তী কালের প্রথম সফল এভারেস্ট অভিযানের দলনেতা স্যার জন হান্ট। পাহাড় ছোট হলেই
কি আর সহজ হয়ে যায় রে? আর পাহাড়ের মাথায় উঠে দাঁড়ানোটাই পাহাড় চড়ার শেষ কথা নয়,
বলেই কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন কাকাবাবু। ‘এটাও জুলাই মাস’, এই কথাটা
সেদিন কাকাবাবুকে একবার বলতে গিয়েও চুপ
করে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল সব কিছুর মধ্যে সংযোগ টেনে আনা এক একসময় একেবারেই কাজের
কথা নয়। তার
চেয়ে লিডার নদীর গান আর দুরের দিগন্তে বরফের আভাষে চোখ রাখা ঢের ভাল।
মকবুল চাচার সঙ্গে দেখা
হয়েছিল দুদিন পর চন্দনওয়াড়িতে। তখন জানতে পেরেছিলাম মকবুল চাচা আসলে একপাল ঘোড়ার
মালিক। এই তীর্থযাত্রার সিজনে তাঁর ব্যস্ততার শেষ নেই। সেই প্রথম দেখেছিলাম,
পুণ্যলোভাতুর যদি অর্থশালী হন, তখন পুণ্য লাভ করতে বিশেষ ক্রিচ্ছসাধন করতে হয় না।
কারণ, ‘ফেল কড়ি মাখ তেল’ উপপাদ্য ঈশ্বরের সদর দফতরেও কাজ করে। আর সেখানেই মকবুল
চাচা অম্লান বদনে বাহন সাপ্লাই দেন। ঘোড়া ভাড়া নিয়ে প্রবল দরদস্তুর এবং হাঁকডাকের মধ্যেই কাকাবাবুকে দেখে একগাল হেসে বুকে জড়িয়ে
ধরলেন মকবুল চাচা। বছর খানেক আগে এক এক্সপিডিসনে এসে নাকি ওদের দুজনের প্রথম আলাপ
হয়েছিল। এই নিয়ে সবে যে তাঁদের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ, সেই বুকে জড়িয়ে ধরা
দেখে বোঝার উপায় ছিল না। আমাকে দেখে মকবুল চাচা বলেছিলেন, ভাতিজা হ্যায় না? মেরে
পাস ছোড় কে জাও জি। ম্যায় ঘুমাউংগা উসকো। কাকাবাবু হেসেছিলেন হা হা করে। পাহাড়ি
মানুষের বন্ধুত্ব কীরকম জবরদস্ত হয় সেদিন অল্প হলেও বুঝেছিলাম।
চন্দনওয়াড়ি থেকেই অমরনাথের হাঁটা শুরু। পরদিন
সকালে উঠেই দেখি শয়ে শয়ে মানুষ পথে নেমেছে। কাকাবাবু বললেন, আমরা একদিন এখানেই
থাকব, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াব, লঙ্গরে খাব। প্রায় সাড়ে ন’হাজার ফুট হাইট এখানকার,
তাই উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে খাপ খাওয়াবো।এই যে এত লোক অসুস্থ হয়ে পড়ছে দেখতে পাচ্ছিস
তার বেশির ভাগই অল্টিচিউড সিকনেসের জন্য। কিন্তু কে এদের বোঝাবে যে বাতাসে
অক্সিজেন কমে গেলে পাপ-পুণ্য ম্যাটার করে না, সব স্রেফ শুন্য হয়ে যায়। শিব ঠাকুর
তো হাই অল্টিচিউডেই থাকেন, তাই তাঁর না হয় আলাদা করে অ্যাক্লাইমেটাইজেসনের দরকার
হয় না।কিন্তু ভক্তদের যা অ্যাটিচিউড সেখানে অল্টিচিউড প্রসঙ্গ না আনাই শ্রেয়। তুই বরং মানুষ দ্যাখ। ভারতের সব প্রান্ত থেকে আসা অগণিত
মানুষ। একবার ভাব তো, ভারতবর্ষের মানুষ নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-মারপিট না করে কেমন
শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে, কষ্ট সহ্য করে পথ চলেছে! ঠিক যেন কেউ এদের হিপনোটাইজ করে রেখেছে,
তাই না? ঠিক যেন ইন্দ্রজাল। কিন্তু প্রশ্ন হল এখানকার যাদুকরটি কে এবং কোথায়? তিনি
কি ঐ গুহাতেই বাস করেন? তাও বছরে এই এক-দুই মাসের জন্য? কাকাবাবুর কথার অর্ধেক
আমার মাথায় ঢোকে না, তবু ঘাড় নাড়ি। ম্যাজিক দেখতে কার না ভাল লাগে। কাকাবাবুকে সে
রাতে একটু ডিস্টার্বড দেখায়।
পরদিন পিসু টপ পার হয়ে শেষনাগ ক্যাম্পে পৌঁছে নিজেদের রাতের আশ্রয় জোগাড় হয়ে
যেতেই দুজনে আবার ঘুরে বেড়াই। এক দোকানে বসে চা খেতে গিয়ে দেখি একজন পথ চলেছে খালি
পায়ে, তার পায়ের ধুলো নেবার জন্যও আবার কিছু লোকও জুটে গেছে। আজ রাতে সে নাকি
শেষনাগেই থাকবে।আমি তার ক্ষতবিক্ষত পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকি। তার কাছে গিয়ে
কাকাবাবু গলা নামিয়ে জিগ্যেস করে, নাম কেয়া হ্যায় আপকা? উত্তর আসে, চেতন। একটা
বিটাডিন মলমের ছোট টিউব চেতনের হাতে ধরিয়ে কাকাবাবু বলে চলেন, আউর কুছ দাওয়াই
চাহিয়ে তো মাঙ্গ লেনা। খালি পায়ের তীর্থযাত্রী কোন উত্তর দেয় না। আমরা চায়ের দোকান
থেকে বেরিয়ে আসি। আমাকে কিছুটা বিচলিত দেখেই বোধহয় কাকাবাবু বলতে থাকেন, নব্বই বছর
আগে অর্থাৎ, ১৮৯৮ সালে স্বামী বিবেকানন্দ এবং নিবেদিতা এই পথেই অমরনাথ দর্শনে
গিয়েছিলেন। আর সম্ভবত পিসু টপ খালি পায়ে পার হয়েছিলেন।
চোখের সামনে ক্ষতবিক্ষত খালি পায়ের এক অজ্ঞাত যাত্রীকে দেখার পর বিবেকানন্দের
উদাহরণ আমার ওপর বিশেষ কোন ছাপ ফেলতে পারছে না দেখেই সম্ভবত কাকাবাবু কথা ঘোরালেন।
পূর্ব দিকের বরফ ঢাকা পাহাড়ের ঢাল দেখিয়ে কাকাবাবু বলেন, ঐ ঢাল বেয়ে একটা পাসে ওঠা
যায় বুঝলি? পাস-টার নাম গুলোল গলি।আসছে বছর ঐ পথে একটা ট্রেক করব আমরা কয়েকজন।
গুলোল গলি পেরিয়ে পৌঁছে যাব রঙ্গমার্গ। তারপর
হামপেট, কানিতাল হয়ে সেই পানিখার। কাশ্মীর থেকে জান্সকার পৌঁছে যাব পাঁচদিনের
মাথায়-বুঝলি কিছু? বুঝলাম কচু, তবু ঘাড় নাড়লাম ঢের। পরদিন মহাগুনাস টপ পার হয়ে
পৌঁছে গেলাম পঞ্চতরনী, আর তার পরদিন অমরনাথ গুহা দেখে বাতাল।
প্রবোধ কুমার সান্যাল তাঁর ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ বইতে লিখেছিলেন, ‘যারা তীর্থের
পর তীর্থ পর্যটন করে বেড়ায়, তাদের মধ্যে আছে কেবল আত্ম-তাড়না, তারা দেবতার পিছনে
পিছনে ছোটে, দেবত্বের স্পর্শ পায় না’। হিমালয়ের অন্দরমহলের খোঁজখবর তিরিশ বছর আগে
আমার কাছে ছিল না, তাই কাকাবাবুর অনেক কথাই সেদিন বুঝি নি। তবে আজ বুঝি তীর্থের
তাড়নায়, পর্বত অভিযানের অছিলায়, এমনকি নিছক ভ্রমনের বাতিকে যারা হিমালয়ে যান তাদের
বেশিরভাগই সেই অন্দরমহলের খোঁজ রাখেন না। কাকাবাবু রাখতেন। মকবুল আর চেতন সে কথার
সাক্ষী। আজ মনে হয়, সেই মকবুল চাচা আর চেতনের জন্যই আমি আমার কাকাবাবুকে চিনতে
পেরেছিলাম। আমার জীবন একটি দর্শন পেয়েছিল। আর সেই জন্যই অমরনাথ আমার কাছে
পুণ্যভূমি। একটি ওভারসাইজড আইস স্ট্যালাগমাইট এখানে নিমিত্ত মাত্র।
-------------------------------------------------------------------
Comments