Skip to main content

ভোলাকাকুর স্বর্ণযুগ


ভোলাকাকুর স্বর্ণযুগ

লেখকের  ব্যক্তব্যঃ এই লেখাটি সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকায়  ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ এ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদ  প্রতিদিনের লেখাটির সঙ্গে যে ছবিটি 'বাস্তবে গুমনামি বাবার ছবি' বলে ছাপা হয়েছে সেই ছবিটি আদপে যে 'বাস্তব'  নয়, এক শিল্পীর মনগড়া, তাও প্রমাণিত হয়ে গেছে। এই লিঙ্কে গেলেই সেটা বিষদে জানা যাবেঃ https://scroll.in/article/757089/how-a-computer-generated-image-came-to-be-used-as-proof-that-a-mysterious-sadhu-was-actually-netaji

খবরের কাগজের পাতার ডিজাইন এবং কোন ছবি তাঁরা ব্যবহার করবেন, তার ওপর লেখকের কোন নিয়ন্ত্রণ সাধারনত থাকে না। এক্ষেত্রেও ছিল না। যাই হোক, এই লিঙ্কে গেলে কাগজের লেখাটি পড়া যাবেঃ https://epaper.sangbadpratidin.in/epaper/m/389654/5d8ffdaa0316a  


শুরুটা অনেকটা হযবরল-র মত। বেজায় গরম। ধর্মতলা চত্বরে একটা কাজ সারতে গিয়ে হাঁসফাঁশ করছি। এমন সময় ভোলাকাকুর ফোন এল। তিব্বতে যাবার উপদেশ না দিয়ে কাকু সরাসরি বাবায় চলে গেলেন। পৃথিবীতে এক বিশেষ শ্রেণীর মানুষ আছেন যারা গোটা প্যারাগ্রাফ শেষ না করে থামেন না। খুঁজে দেখবেন, আপনার কাছেপিঠেই এই ধরণের মানুষ পেয়ে যাবেন। ভোলাকাকু সেই গোত্রের, তাই, বোবা হয়ে গিয়ে শুনতে লাগলাম। কাকু বলে চললেন- ‘বাবা, অর্থাৎ, গুমনামি বাবার কথা বলছি রে। আমি তো প্রথম থেকেই জানতাম। এবার সিনেমা হয়ে আসতে চলেছে। হুঁহুঁ বাবা, এইবার দুধ কা দুধ, পানি কা পানি হওয়া আটকায় কে! ওরে, আমাদের নেতাজীই যে এতদিন ঘাপটি মেরে গুমনামি বাবা সেজে বসেছিলেন, তা বুঝতে কি আর এত সময় লাগে রে? আমাদের পটলার কথা মনে আছে তো? সেই যে একবার ক্লাস এইটে ফেল করে বাড়ি থেকে পালালো যে পটলা? হ্যাঁ, তার কথাই বলছি। তো সেই পটলাকে, পাক্কা দশ বছর পরে, কীভাবে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল তা জানিস কি?’ আমি ‘না’ বলার আগেই উল্টোদিক দিক থেকে উত্তর এল, ‘ওর ছাগলের মত কান দেখে। আরে সেই যে সেবার বটতলা ট্রাভেলসের সঙ্গে বেনারস গেছিলাম না? সেবারেই তো মোগলসরাই স্টেশনে একেবারে হাতেনাতে পাকড়াও করে আবার আমাদের খড়দা ফিরিয়ে আনলাম। যতই দাড়িগোঁফের জঙ্গল বানাও, ঐ লম্বকর্ণ লুকোবে কী করে? একেবারে কান ধরে টেনে তুললাম আমাদের বগিতে। তুই নিশ্চয়ই ভাবছিস নেতাজীর সঙ্গে পটলার কি সম্পর্ক? বুঝলি না তো? বুঝবি কী করে? বুঝতে চাস না যে। আরে গুমনামি বাবা হয়ে যতই দাড়িগোঁফের আড়ালে তিনি নিজেকে রাখুন না কেন, ঐ হাসি, ঐ চোখ, ঠিক ওনাকে ধরিয়ে দেবে। এতদিনে একটা কাজের কাজ হল বটেযেই সোনালি হলে সিনেমাটা লাগবে, আর সঙ্গেসঙ্গে ভারতবর্ষের সবথেকে বড় রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে,’ এই পর্যন্ত বলে, যেই ভোলাকাকু একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়েছেন ওমনি আমি, ‘ঠিক বলেছ ভোলাকাকু, তবে এখন আমার বাস এসে গেছে, পরে আবার শুনছি, কেমন,’ বলেই ফোনালাপে দাঁড়ি টেনেছি। 


বেলুড়মঠ-ধর্মতলা মিনিবাস আসলে ইতিহাসের জগদ্দল পাথরের মত এক যাত্রী পরিষেবা বিগত চল্লিশ বছরে তার মধ্যে কোন রদবদল, এমনকি জানলার রড-বদল, কোনটাই ঘটেনি এবং সম্ভবত আগামী চল্লিশ বছরেও তাঁরা সেই ট্র্যাডিশন এই ভাবেই বজায় রাখবেন। সেই ঘুপচি টিনের বাক্স, সেই হাঁটু ঘষা সিট এবং তাতে ঠাসা সহযোদ্ধার দল কোন একটা বাস স্টপ এলে যে ভাবে লোকজন হৈহৈ করে নামে, তাতে ট্রোজান হর্সের পেট থেকে বেরিয়ে আসা গ্রীক সৈনিকদের কথাই মনে পড়ে যায়; তাই সহযোদ্ধাই বললাম তবে সেদিন কী যে হল, আমি হুট করে জানলার ধারে বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। বসতে না বসতেই আবার ফোন বেজে উঠল, আবার ভোলাকাকু। এবার অবশ্য ধরার আগেই ফোনটা কেটে গেল। কেন জানি না, সেই মুহুর্তে আমার মনে হল, ভোলাকাকুরা কমবেশি পৃথিবীর সব জাতির মধ্যেই আছেন এবং এক বিপুল সংখ্যাতেই আছেন। এঁরা বিশ্বাস করেন, আমেরিকানরা চাঁদে পা রাখেন নি, ওটা হলিউডি কারসাজি ছিল। যীশু খৃষ্ট আশি বছর বেঁচেছিলেন, তাঁর শেষ জীবন লাদাখে কেটেছিল, শ্রীনগরে তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছিল। চৈতন্যদেবকে পান্ডারা পুরীর মন্দিরের গরুড় স্তম্ভের পাশে পিটিয়ে মারার পর, তাঁকে তোটা গোপীনাথে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। দেবতারা আসলে গ্রহান্তরের মানুষ। দিল্লীর মরচে-বিহীন লৌহস্তম্ভ ভিনগ্রহের প্রাণীরা এসে বানিয়েছিল। টুইন টাওয়ারের উগ্রপন্থী হানা জর্জ বুশ নিজে করিয়েছিলেন।মার্কিন এক ডলারের নোটে ছাপা ‘আই অফ প্রভিডেনস’ আসলে গুপ্ত সমিতি ‘ইলিউমিনাতি’র স্বাক্ষর। বিশ্ব বিখ্যাত রক ব্যান্ড ‘বিটলস’ এর পল ম্যাকার্টনি ১৯৯৬ সালেই মারা গেছিলেন এবং সেই থেকে একই রকম দেখতে একটা লোককে পল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং একটা ভাঁওতা, কারণ এই শীতেও ইওরোপ এবং আমেরিকায় খুব বরফ পড়েছে এবং সব শেষে, আজকের হট টপিক, গুমনামি বাবাই ছদ্মবেশী নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস।  এইরকম সব বিচিত্র ব্যাপারস্যাপার ভোলাকাকুর মত মানুষজনকে সর্বদাই সজীব এবং তাঁদের পরিচিত মানুষজনকে উদগ্রীব করে রাখে। অবশ্য এতদিনে আমি হাড়েহাড়ে বুঝে গেছি যে ভোলাকাকুর ভোলাভালা সরল মনে, ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিকেরা উচ্চমানের গবেষক এবং ডেভিড ইকে, এরিক ফন দানিকেন, অ্যালেক্স জোনস-দের মত প্রমাণিত ভাঁওতাবাজরাই অবিসংবাদী সত্যান্বেষী হয়ে বসে আছেন।  


নেতাজী বিমান দুর্ঘটনায় সত্যিই মারা গেছেন কিনা এ বিষয়ে সুনিশ্চিত হতে কেবল ভারতীয়রাই সচেষ্ট ছিলেন না। ব্রিটিশ, জাপানি এবং আমেরিকানরাও পৃথক ভাবে, বহুবার তাদের তদন্ত চালিয়েছিলেন। প্রত্যেকবারই, তদন্তকারী ব্যক্তি কিংবা কমিশনগুলি একটিই সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছিলেন- ১৮ আগস্ট, ১৯৪৫, তাইহোকু এয়ার স্ট্রিপে, বিমান দুর্ঘটনায় মারাত্মক রকম জখম এবং গুরুতর ভাবে দগ্ধ হয়ে নেতাজীর মৃত্যু হয়েছিল। জ্বলন্ত, বিধ্বস্ত, ভেঙে পড়া বিমান থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে বেরিয়ে যখন নেতাজীর মুখোমুখি হয়েছিলেন হাবিবুর রহমান, তখন তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল সেই মুখ তখন ‘ব্যাটার্ড বাই আয়রন, বার্নট বাই ফায়ার’। সেই বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো একমাত্র হতভাগ্য ব্যক্তি ছিলেন না নেতাজী, যেমন ছিলেন না হাবিবুর রহমান একমাত্র বেঁচে থাকা সাক্ষী। সেই একই দুর্ঘটনায় মারা গেছিলেন নেতাজীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী জেনারেল সুনামাসা শিদেই-ও। জেনারেল শিদেই-এর পরিজনেরা কোনদিন তাঁর মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেননি। শাহনয়াজ খান কমিটির সদস্যেরা জাপানে গিয়ে জেনারেল শিদেই-এর সার্ভিস রেকর্ডে দেখেছিলেন লেখা আছে- মৃত্যুর তারিখ ১৮ আগস্ট, ১৯৪৫, মৃত্যুর স্থান- তাইহোকু এয়ার স্ট্রিপ, মৃত্যুর কারণ- ডেথ বাই ওয়ার। একজন সৈনিকের কাছে এর থেকে সম্মানের আর কিছুই হতে পারে না। হাবিবুর রহমান ছাড়াও আরও ছ’জন জাপানি সহযাত্রী প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। এই ছ’জন জাপানি সৈনিকের মধ্যে পাঁচজন- লেফটেন্যান্ট কর্নেল শিরো নোনোগাকি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাদেও সাকাই, মেজর তারো কোনো, ক্যাপ্টেন কেইকিচি আরাই এবং মেজর ইহাহো তাকাহাসিকে একাধিক বার ভারতের, ব্রিটেনের এবং জাপানের বিভিন্ন সময়ে গঠিত কমিশনের প্রতিনিধিরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। তাইহোকু এয়ার স্ট্রিপের গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা এবং গ্রাউন্ড স্টাফেরা, যারা সেই অভিশপ্ত ‘টুইন-ইঞ্জিন হেভি বম্বার অফ ৯৭/২ (স্যালি)’ মডেলের বিমানটিকে শেষবার দেখভাল করেছিলেন এবং বিমানটি ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন, তাঁদেরও বয়ান নেওয়া হয়েছিল। নেতাজীর জীবনের শেষ কয়েক ঘণ্টায় যারা তাঁর প্রাণ বাঁচানোর প্রচেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন, তাইপেই নানমোন মিলিটারি হাসপাতালের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সার্জেন ডঃ ক্যাপ্টেন ইওশিমি তানেওশি, তাঁর সহকারী ডঃ সুরুতা, এমনকি সেই চিনা নার্স সান পি শা-কেও খুঁজে বার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। নেতাজীর মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত ছিলেন ইনটারপ্রেটার নাকামুরা। নাকামুরা যখন হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন, তখনও নেতাজী কথা বলছেন। নাকামুরাকে নেতাজী বলেছিলেন, ‘আমার আরও কিছু লোক আমার পরেই ফরমোসা এসে পৌঁছবে। ওদের একটু দেখাশোনা করবেন’। তাঁর আধ ঘণ্টা পরেই খোঁজ নিয়েছিলেন, জেনারেল শিদেই কোথায়? তার কিছু পরে, রাত ন’টা নাগাদ বলেছিলেন, ‘আমি একটু ঘুমোতে চাই’। সেই নেতাজীর শেষ কথা। নাকামুরা, মেজর নাগামোতো এবং হাবিবুর রহমানের উপস্থিতিতে নেতাজীর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল। নাকামুরা, নাগামোতোর বয়ানও নেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৫ এর সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৭৪ পর্যন্ত সময়ের বিস্তারে সেই ইন্টারভিউ গুলি ঘটেছিল বিভিন্ন স্থানে এবং বিচ্ছিন্ন ভাবে। এঁদের প্রত্যেকের বিবরণের সঙ্গে হাবিবুর রহমানের রিপোর্ট হুবহু মিলে গিয়েছিল। সকলেই নিঃসংশয় ছিলেন বিমান দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর ব্যাপারে।


সকলেই, কিন্তু, একজন ছাড়া। ফয়জাবাদের জনৈক গুমনামি বাবাই স্বয়ং নেতাজী- প্রথম থেকে এই কথা একরকম ঘোষণাই করে,  ১৯৯৯ সালে আসরে নেমেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক মনোজ মুখার্জি, শুরু হয়েছিল নেতাজী-মৃত্যু ‘রহস্যে’ আরও এক কমিশন। এবং রহস্য গল্প গিলে খাওয়ার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি বশতই মুখার্জি কমিশন জনমানসে বেশ সাড়া ফেলেছিল। যথা সময়ে, মুখার্জি কমিশনের সুপারিশ মত, গুমনামি বাবা এবং বসু পরিবারের ডি এন এ পরীক্ষা করে তুলনা করা হয়েছিল। আবার, নেতাজীর হাতের লেখার সঙ্গে গুমনামি বাবার হাতের লেখা বিশেষজ্ঞকে দিয়ে মিলিয়ে দেখাও হয়েছিলকিন্তু, শেষ পর্যন্ত এসবের কোনটাই যখন মেলেনি, তখন কমিশন গঠনের সাত বছর পর, এক বিচিত্র রিপোর্ট পেশ করেছিলেন মনোজ বাবু। সেই রিপোর্টে উনি জানিয়েছিলেন, ১৯৪৫ এর ১৮ আগস্ট, তাইহোকুতে নাকি কোন বিমান দুর্ঘটনাই ঘটেনি। অবশ্য, ২০১০-এর একটি ইন্টারভিউতে একথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে প্রথম থেকেই একটা পুর্বকল্পিত ধারনা নিয়েই তিনি তাঁর কাজে নেমেছিলেন। বলা বাহুল্য, পার্লামেন্টে মুখার্জি কমিশনের সেই রিপোর্ট বাতিল হয়ে গিয়েছিল। একথা ঠিক যে, দেশ স্বাধীন হবার পর, প্রথম কয়েক দশক জুড়ে নেতাজীর এই রকম মৃত্যু দেশের এক বড় অংশ স্বাভাবিকভাবেই অন্তর থেকে মেনে নিতে পারেনি। এক না একদিন তাদের দেশনায়ক ঘরে ফিরবেন, এই বিশ্বাস অনেকদিন ধরেই প্রবহমান ছিল। জনগণের এই আবেগকে কাজে লাগিয়েছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ এবং কিছু বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দল। জন্ম নিয়েছিল একের পর এক ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব। আজ অবধি নেতাজীকে অমুক জায়গায় তমুকের বেশে দেখতে পাওয়া গেছে বলে যতগুলি বিভ্রান্তিকর তত্ত্ব প্রচার করা হয়েছে, তাঁর কোনোটিরই কোন বাস্তবসম্মত প্রমাণ পাওয়া যায় নি  


শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, মার্কিন জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ কোনও না কোন ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে ‘বিশ্বাস’ করেন। ব্রিটিশ মনস্তত্ত্ববিদ ক্যারেন ডগলাস তাঁর এক সাম্প্রতিক প্রবন্ধে এই ‘কনস্পিরেসি থিয়োরিস্ট’-দের কোনও একটা ঘটনায় ‘বিশ্বাস’ এবং সেই বিশ্বাসের লাগাতার প্রচারের কারণ হিসেবে একধরনের আত্মমুগ্ধতার প্রতিপালন এবং কোন একটা প্রচ্ছন্ন অভিসন্ধিকে দায়ী করেছেন। প্রথমটি, আত্মমুগ্ধতা। আমিই সব থেকে সুন্দর, আমি সবার থেকে একটু আলাদা, আমি অন্যরকম সিনেমা বানাই- এই ধরনের নারসিসিজম আর কী! দ্বিতীয়টি, অভিসন্ধি, মোটিভ- তা হতে পারে রাজনৈতিক, বানিজ্যিক কিংবা আরও অন্য কিছু। ষড়যন্ত্র-ত্বত্ত্ব, গুজব ইত্যাদি বাজারে চিরকালই ‘খায়’ ভাল। তবে, তাইহোকু বিমানবন্দরে একটি বিমান ভেঙে পড়া এবং সেই দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যুর দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটিকে নতুন করে এক ‘অন্তর্ধান রহস্যের মোড়কে’ বই এবং চলচ্চিত্র রূপে পেশ করার পিছনে কেবলমাত্র বাণিজ্যিক বিপণন নেই। এখানেও সেই একই আত্মপ্রচার এবং প্রচ্ছন্ন অভিসন্ধির গড্ডলিকা কাজ করে চলেছে। বুঝিয়ে বলছি।  

  
কগনিটিভ সাইকোলজির অধ্যাপক ডেভিড লুডেন ‘সাইকোলজি টুডে’তে লিখেছেন, “ষড়যন্ত্র তত্ত্ব গুলি আসলে কিছু ভ্রান্ত ধারনার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। যেমন ধরুন, হয়ত কারো ধারনা ছিল অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী সিডনি। কিন্তু যেই সে জানতে পারল, সিডনি নয়, অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী আসলে ক্যানবেরা, একটু অবাক হলেও, সে নিজের ভুল শুধরে নিল। কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে কোন ভ্রান্ত ধারনাকে প্রতিষ্ঠা করার নেপথ্যে কোন অভিসন্ধি থাকে, সেক্ষেত্রে ভুল শুধরে নেওয়াটা সহজ হয় না।” এটা আসলে বিপণনের এক প্রাচীন পদ্ধতি- বোঝাতে না পারলে, বিভ্রান্ত করে দাও কনভিনস করতে ব্যর্থ হলে, কনফিউস করে দাও। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ এর কথা। আমরা জানি, প্রকৃতির বিরূদ্ধে গিয়ে মানুষের ধ্বংসাত্মক কাজকর্মের জন্য বিশ্বের উষ্ণতা বিপজ্জনক ভাবে বাড়ছে। অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয় থেকে বাঁচার পন্থা হিসেবে বিশেষজ্ঞরা যে পদক্ষেপগুলি রাষ্ট্র এবং তার নাগরিকদের নিতে উপদেশ দিচ্ছেন, তা মেনে নিলে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় ব্যাপক এবং কঠোর পরিবর্তন আবশ্যিক। এদিকে, যারা প্রচার চালাচ্ছেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন ব্যাপারটা একটা ভাঁওতা, তাঁরা বলছেন, ‘ধুর, এসব বাজে কথা, ভিত্তিহীন। দেখতে পাচ্ছেন না এ বছর কী রেকর্ড-ভাঙা ঠান্ডা পড়েছে?’ এই যুক্তি শুনে, একটা বড় সংখ্যক মানুষের মধ্যে দোটানার সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ, হুট করে নিজের ‘কমফর্ট জোন’ থেকে বেরিয়ে না আসার একটা ছুতো আমাদের সামনে রুপোর থালায় সাজিয়ে পরিবেশন করা হচ্ছে। এখানে আত্মমুগ্ধতা না হলেও, আত্মসন্তুস্টি কাজ করছে। এবং, ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং একটি ধাপ্পাবাজি’- এই থিয়োরি প্রচারের কায়েমি স্বার্থটা যে কিছু দৈত্যাকার কর্পোরেট সংস্থাগুলোর, তাদের মালিক এবং সেই মালিকদের পকেটস্থ রাজনৈতিক নেতাদের, তাও কারও অজানা নয় আজকে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখার জন্য একটা কনস্পিরেসি থিয়োরিই যে যথেষ্ট, তা বোঝাতে পেরেছি আশা করি। নেতাজীর মৃত্যুকে ঘিরে একটা আরোপিত রহস্যের জাল বুনে চলার পিছনেও সেই একই ‘ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে’। নেতাজীর সমসাময়িক এক রাজনেতাকে তাঁর ‘চিরশত্রু’ এবং আমাদের দেশের ‘সুপার-ভিলেন’ প্রতিপন্ন করার জন্য এর থেকে ভাল ‘ফ্রেম-আপ’ আর হয় না যে। 


আজ স্বাধীনতার ৭২ বছর পর সারা দেশ জুড়ে এমন কোন শহর বা গ্রামাঞ্চল নেই যেখানে অন্তত একটা স্কুল, কলেজ, ক্লাব, রাস্তা, স্টেশন, লাইব্রেরি, স্ট্যাচু, কিংবা সরোবরের সঙ্গে নেতাজী’ কিংবা আজাদ হিন্দ’ কিংবা  জয় হিন্দ’ জড়িয়ে নেই! তার অর্থ কি এই যে নেতাজীর ভাবধারায় গোটা দেশ আজ উদ্বুদ্ধ?  গোটা দেশ নেতাজিময়তায় আপ্লুত?  সাইনবোর্ডে যাই লেখা থাক, আপনি এবং আমি, দুজনেই জানি যে, যেকোন জিনিষের বহুল ব্যবহারে যা হয়ে থাকে এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এক, নেতাজীকে নিয়ে এক বা একাধিক স্টিরিওটাইপ তৈরি হয়েছে। দুই, গোটা ব্যাপারটা ভাসা-ভাসা এবং অর্থহীন হয়ে গেছে। প্রথম বিষয়, স্টিরিওটাইপ, মানে একটা ‘সিংগল স্টোরি’-র বিপদ। মেক্সিকান মানেই ইললিগাল ইমিগ্রান্ট, মুসলমান মানেই উগ্রপন্থী, বৌদ্ধ মানেই অহিংস- এই ধরনের স্টিরিওটাইপ। আর এটা থেকেই জন্ম নিয়েছে দ্বিতীয় বিষয়- ‘নেতাজী’, ‘আজাদ হিন্দ’, ‘জয় হিন্দ’, এই সব শব্দগুলোর পটভূমিকা, প্রকৃত অর্থ, প্রয়োগ, তাৎপর্য এবং আজকের দিনে প্রাসঙ্গিকতা - সব হারিয়ে গেছে। এই ঘটনাটি, আমার মনে হয় একধরনের সামাজিক ‘semantic satiation’তার ওপর, দশকের পর দশক ধরে, বহু ঐতিহাসিক সত্যেরঅমিশনএবংসাপ্রেসন আজকের সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে এক মিথ্যার বেসাতির আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছে জন্ম নিচ্ছে ‘স্বঘোষিত’ নেতাজি-গবেষকের দল।জয় হচ্ছে ষড়যন্ত্রবাদের। ফলে, নেতাজীর কাজ, দেশগঠনের পরিকল্পনা নিয়ে চর্চা না করে মানুষ আজ মনোরঞ্জন খুঁজছে ভিত্তিহীন গসিপে সুস্থ সমাজ এবং রাজনীতিতে এ এক বিপজ্জনক এবং বিষাক্ত প্রবণতা। সেইদিন আর নেই, যখন ষড়যন্ত্রের গুজব বেচে খাওয়া লোকেদেরও, কিছু অর্ধসত্য কিংবা খন্ডচিত্রের প্রয়োজন হত। আজ গুজব রটাতে গেলে কেবল একটু সন্দেহ, একটু বিদ্বেষই যথেষ্ট।তাই, ভোলাকাকুদের মত ষড়যন্ত্র-ত্বত্ত্ব বিলাসীদের আজ স্বর্ণযুগ অতএব, গোঁজামিলের গালগল্পকে যদি বেঁধে ফেলা যায় টানটান চিত্রনাট্যে এবং অভিনয় করানো যায় তারকাদের দিয়ে, তাহলে তা শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য না হলেও, মুখরোচক তো হবেই সেই ছবি দেখে এক বৃহৎ সংখ্যক দর্শক ঘাড় নেড়ে বলবেন, কি জানি বাপু, হলেও তো হতে পারে! আর পরিচালক মুচকি হেসে বলবেন, ফুচকা যে হেলথ ফুড নয়, তা কি প্রমাণিত হয়েছে? এই লেখার শেষটাও তাই অনেকটা হযবরল-র অন্তিম প্যারাগ্রাফের মত আরেকবার পড়ে দেখুন, ঠিক বুঝতে পারবেন  

*****


Comments

Popular posts from this blog

Across The Sahara on a Bicycle

Across The Sahara on a Bicycle Between the things we get And the things we celebrate Flows a desert                            Lest we forget. #SaharaQuartet Background: My Africa My first exposure to the real Africa in 2005 after climbing Kilimanjaro. Scanned from slide. On top of Kilimanjaro in 2005 with a copy of Tathyakendra magazine. Scanned from slide I first visited Africa (Tanzania to be specific) in 2005. I hiked Kilimanjaro and came back home. It was just a tourist thing I did. But in spite of being wrapped up in an itinerary and a travel package of all things touristy; something very curious happened. I got even more inquisitive about Africa. I wanted to go back to Africa. Not as a tourist, but as a drifting wanderer, living an ever curious life. But for that I had to wait a good seven years. In 2011, while I was exploring the barriers of the Nanda Devi Sanctuary in ...

To the Mountains of the Moon: A Journey from Fiction to Facts

In 1937, Bibhutibhushan Bandyopadhyay chronicled the adventures of a Bengali boy named Shankar. This novel was named 'Chander Pahar' (English: 'Mountains of the Moon', as the fiction refers to a range of mountains and not a single standing mountain). 'Chander Pahar' went on to become one of the most loved adventure stories in the Bengali literature. In his lifetime, Bibhutibhushan wrote 16 novels and over 200 short stories. Interestingly, even though most of Bibhutibhushan's works were largely set in rural Bengal; in this particular novel the writer chose the setting of 1909 Africa. Bibhutibhushan Bandyopadhyay (1894-1950) In the story 'Chander Pahar', our protagonist Shankar gets a lucky break to go out from his little riverside village in Bengal to work for the Uganda Railway. Thus begun his sudden and long journey from the mundane to the extraordinary. A roller coaster ride through adventures involving the infamous man eating lions of Tsav...

Straight from a Story Book: Part I

It all started with a story book. In 1937, Bibhuti Bhushan Bandyopadhyay , one of the leading writers of modern Bengali literature penned ' Chander Pahar '. It is a story of a 22 year old young man from rural Bengal who sets out to Africa on an adventure of a lifetime in 1909. (If you have not read the book already you can read the plot summary here: https://en.wikipedia.org/wiki/Chander_Pahar ) Like millions of Bengali readers I had read this adventure story when I was a kid and then as I grew up, as indicated by its publisher (juvenile literature); it became a thing of the past, a childhood fantasy for me.  It is only in recent years, after I climbed Kilimanjaro (2005), I picked up 'Chander Pahar' again. It is then, the book started opening new meanings and fresh directions for me. It is then I began to understand the meaning of the Swedish proverb- 'In a good book the best is between the lines' .  My repeated readings of 'Chander Pah...