অচেনা মানুষের অকারণ কৈফিয়ৎ

(এই লেখাটি বিকাশের অসুখের পরের পর্ব। পাঠক যদি  'বিকাশের অসুখ' পড়তে চান তাহলে এই লিংকে যেতে পারেনঃ https://himalaya-raja.blogspot.com/2021/06/blog-post.html

অচেনা মানুষের অকারণ কৈফিয়ৎ 

“বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালবাসো তুমি?

আমি ভালবাসি মেঘ, চলিষ্ণু মেঘ…উঁচুতে…ঐ উঁচুতে…

আমি ভালবাসি আশ্চর্য মেঘদল।” 

- ( বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে ধরা দেওয়া বোদলেয়ারের দ্য স্ট্রেঞ্জার কবিতার শেষ কটি লাইন)  


এতদিনে বেশ বুঝে গেছি রাজনীতি আমার জীবনে কখনও আলোচনার বিষয় ছিল না। ইদানীং, কখনোসখনো বিজ্ঞের মত দেশের ও দশের সম্পর্কে কিছু বিড়বিড় করে বলে বসলেও, এটা ঠিক যে আপনাদের সমাজ গোল্লায় গেলে আমার কিস্যু আসে যায় না। আপনাদের শিক্ষিত, প্রগতিশীল, আধুনিক মানব সভ্যতায় আমার বেশ অরুচি। কারণ, আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনাদের অসুখ বেশ গুরুতর এবং আমার কাছে সেই অসুখের একমাত্র অ্যান্টি-ডোট আমার অ্যাডভেঞ্চার-নিষ্ঠতা। 


বিগত বিশ বছরে একটা প্যাটার্ন আমার নিজের জীবনে আমি লক্ষ্য করেছি। পর্বতারোহণের পরিচিত বৃত্ত যখনই অসহ্য হয়ে উঠেছে, তখনই ভেসে গেছি ভবঘুরেমির ভেলায়, আবার কিছুদিন পরেই ফিরে এসেছি সেই পর্বতারোহণে। ভবঘুরেমির তৃষ্ণা আমার অকারণে বেরিয়ে পড়ার পাসপোর্ট, আর পর্বতারোহণ হল ঘরে ফিরে আসা। তাই, আমার ভবঘুরেমির কোন বিশুদ্ধ, সীমাবদ্ধ সংজ্ঞা নেই। পর্বতারোহণ এবং ভবঘুরেমি এই দুই মিলেই তৈরি হয়েছে আমার জীবনের অর্কেস্ট্রার বিচিত্র সিমফনি। এখানে রাহুল সাংক্রিত্যায়ন, পল থেরু, এরিক শিপটন, প্রিমো লেভি, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, বুদ্ধদেব বসু, এডোয়ার্ড লিয়ার এবং সুকুমার রায় কোনও এক অন্যমনস্ক অসাবধানতায় মিশে গেছেন বোদলেয়ারের দ্য স্ট্রেঞ্জারে।




আমার মনে হয়, লাগামছাড়া ক্যাপিটালিজম অ্যাডভেঞ্চারকে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করে দিতে চাইলেও সারতঃ তা একটি জীবন যাপনের পদ্ধতি। 

পাশ্চাত্যে শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই প্রকৃতির প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছিল। সেই পরিবর্তনের প্রভাব অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্ব জুড়ে। এতদিন যে প্রকৃতি ছিল মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, ক্রমশ সে হয়ে দাঁড়াল দূরের গন্তব্য। প্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তা তার আর থাকল না। প্রকৃতিকে এবার সে অন্য চোখে দেখতে আরম্ভ করল। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, অর্থাৎ, মানব সভ্যতার আধুনিক ইতিহাসে যে সময়টাকে দ্য গ্রেট ডিভাইডের সময় ধরা হয়; মোটামুটি সেই সময় থেকেই দেখা যায় মানুষ আর প্রকৃতিতে সম্পৃক্ত হয়ে বাস করে না। প্রকৃতি হয়ে দাঁড়ায় তার কারখানার কাঁচা মালের যোগান ক্ষেত্র। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এই বিচ্ছেদ তার মনে বিরহের জন্ম দেয় এবং সম্ভবত সেকারণেই সে মাঝেমধ্যে সময়-সুযোগ পেলে প্রকৃতিতে ‘ফিরে যায়’ কিংবা ‘ফিরে যাবার’ একটা স্বপ্ন তার অবচেতনে কাজ করে চলে। মানুষের এই প্রকৃতিতে ‘ফিরে যাওয়ার’ পন্থা কিংবা প্রচেষ্টাকে কেউকেউ  শ্রেণীবিভাগ করেছেন তিনভাগে-- রোম্যান্টিক, পিকচারেস্ক এবং অ্যাথলেটিক। যে অ্যাডভেঞ্চারকে আমি একটি জীবন যাপনের পদ্ধতি হিসাবে দেখাতে চাইছি তা হল এই রোম্যান্টিক, পিকচারেস্ক এবং অ্যাথলেটিক পন্থার সমন্বয়। 

বিজ্ঞান  ও প্রযুক্তির হাত ধরে এক মহাপ্লাবনের মত আছড়ে পড়া শিল্পায়ন যদি এই (গ্রেট ডিভাইডের) সময়ের নতুন আকাশ হয় তাহলে সেই আকাশে ফুটে ওঠা এক রামধনুর বিভিন্ন স্তরে তাঁদের নিজস্ব রঙ নিয়ে ছড়িয়ে আছেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী, কীটস, কোলরিজ থেকে জেমস কুক এবং অ্যালেক্সান্ডার ফন হামবোল্ট। এঁরা প্রত্যেকেই নিজের মত করে নিজেদের জীবন এবং কাজে সেই সমন্বয়ের প্রকাশ রেখে গেছেন। 

তাই, মানুষের সমাজে অ্যাডভেঞ্চারের ন্যায্যতা প্রতিপন্ন করা কিংবা তার প্রয়োজনীয়তার স্বপক্ষে সওয়াল করা যদি একান্তই জরুরী হয়ে থাকে তাহলে জানিয়ে রাখি-- অ্যাডভেঞ্চারের জন্যই অ্যাডভেঞ্চার, ভবঘুরেমির জন্যই ভবঘুরেমি। পৃথিবীকে, তার বায়ুমণ্ডলকে, তার জীবজগতকে বিপন্ন করে দেওয়াটাই যে আপনাদের সমাজের অভিমুখ তা তো স্পষ্ট। তাই ভবঘুরেদের মতিগতি বোঝা আপনাদের কম্মো নয়। তাদের কোনও প্রশ্ন করার অধিকারও আপনাদের নেই। ছেড়ে দিন। আপনারা বরং মন দিয়ে গ্রিন হাউস গ্যাস এমিসন আরও ত্বরান্বিত করুন। প্রতিদিন বেশ কয়েকটি করে প্রজাতিকে বিলুপ্তির দিকে দ্রুত এগিয়ে দিয়ে মানব জাতির যথাসাধ্য উন্নতি সাধন করুন।  

৩ 

যুব সমাজে অ্যাডভেঞ্চারের প্রয়োজনীয়তা গোছের উপযোগিতামূলক পাঁচালীর ব্যাডেন-পাওয়েলিয় প্রচারকার্য আর যার হোক, আমার জন্য নয়। রাহুলজী যে ধরণের ভবঘুরেদের দেখতে চেয়েছিলেন এবং ভবঘুরেমির শ্রেণীবিন্যাস করেছিলেন, তাদের উঠোনে আমি মাঝেমধ্যে পায়চারি করলেও, জ্যাক কেরোয়াক আমাকে তাঁর বোহেমিয়ানায় প্রভাবিত করলেও, বোদলেয়ারের ‘ফ্ল্যানার’ আমাকে আকর্ষণ করলেও; মন থেকে সমাজকে এক নিরাপদ দূরত্বে রেখে দিতে আমি বরাবরই চেয়েছি। লারেন স্টোভার তাঁর ‘বোহেমিয়ান ম্যানিফেস্টো’ বইতে মূলত পাঁচ রকমের বোহেমিয়ান চিহ্নিত করেছেন- নব্য, জিপসি, বীট, জেন এবং ড্যান্ডি। আমি অনেক ভাবনা চিন্তা করে দেখেছি এই পাঁচটা আর্কিটাইপের কোনটাতেই আমি ঠিক ফিট করি না। আবার জার্মানির যুব সমাজের একাংশের মত নিজেকে একেবারে সমাজ বহির্ভূত ‘আউস্টিগা’-র দলেও ফেলতে পারিনি। 





‘সভ্যতা ও ফ্যাসিবাদ’ প্রবন্ধে কবি বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘নিরিবিলি ঘরের কোণে বসে পড়াশোনো করতে’ ও ‘মাঝে মাঝে এক-আধটা কবিতা লিখতে’ চান তিনি। তবু ফ্যাসিবাদের মতো একটি রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কলম ধরতে তিনিও বাধ্য হয়েছিলেন। সেই প্রবন্ধেই রাজনীতিবিমুখ বুদ্ধদেব অপকটে বলেছেন: ‘শান্তির সময়, সুখের সময় নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব, হয়তো সে অবস্থাই স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল, কিন্তু চারিদিকে যখন অশান্তির আগুন লেলিহান হয়ে জ্বলে উঠে তখন কবি বলো, শিল্পী বলো, ভাবুক বলো কারো পক্ষেই মনের মধুর প্রশান্তি অক্ষুণ্ণ রাখা আর সম্ভব হয় না, যার প্রাণ আছে তার প্রাণেই ঘা লাগে। ...তাই আজ পৃথিবী ভ’রে লোক যখন তার বীভৎসতম মূর্তিতে প্রকট তখন আমরা কবিরা, শিল্পীরা স্বভাবতই, নিজের প্রকৃতির অদম্য টানেই, ঐ বীভৎসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবো—এর মধ্যে রাজনীতির কোনো গূঢ়তত্ত্ব নেই, আমাদের মনুষ্যত্বের, কবিচরিত্রের এটা ন্যূনতম দাবি।’(ঋনঃ রাজীব সরকার, প্রথম আলো) 


বুদ্ধদেব বাবুর যা এক-আধটা কবিতা, আমার কাছে তা একটা পর্বতাভিযান কিংবা আফ্রিকা মহাদেশের বুকে একটা সাইকেল নিয়ে নিরুদ্দেশ হবার মত ঘটনা। তাই পথ চলতে গিয়ে যখন চারপাশে ফ্যাসিবাদের বাড়বাড়ন্ত আবারও চোখে পড়ে তখন তা কবির মত এই সমাজ-নিঃস্পৃহ ভবঘুরেকেও নাড়া দেয়। কারণ, ভবঘুরেরও মনুষ্যত্বের, চরিত্রের এটা ন্যূনতম দাবি। এরমধ্যেও রাজনীতির কোনো গূঢ়তত্ত্ব নেই। 

তবে, আমি যেমন বিশ্বাস করি অ্যাডভেঞ্চার ব্যাপারটা জীবন যাপনের এক পদ্ধতি, এক ধরনের আর্ট, ঠিক তেমনই সমাজ-নিঃস্পৃহ অ্যাডভেঞ্চারময়তা আমার কাছে এক ধরণের কলাকৈবল্য। 


এবং দিনের শেষে আমার চারপাশের লোকজনের মাঝখানে এক অদ্ভুত অচেনা মানুষ হয়ে থাকতেই আমার ভাল লাগে। সমাজ সংস্কার, ধর্ম রক্ষা আপনারাই করুন না! আমি না হয় সেই লিয়ারের ( এবং সুকুমারের, আচ্ছা না হয় সত্যজিতের) জুম্বলিদের মত  ছাঁকনি চেপেই সাগর পাড়ি দেব।    



Comments

Popular posts from this blog

Across The Sahara on a Bicycle

To the Mountains of the Moon: A Journey from Fiction to Facts

Straight from a Story Book: Part I