লকডাউন স্বগতোক্তি ২


লকডাউন স্বগতোক্তি-২


আমার এক দাদার কাছে শুনেছিলাম, ‘অ্যালগরিদম’ ব্যাপারটাকে রপ্ত করে ফেলার মধ্যেই নাকি আজকাল লুকিয়ে থাকে কোম্পানি গুলোর বাণিজ্যিক সাফল্য। দাদা আরও বলেছিলেন, অ্যালগরিদম ঠিকঠাক বিশ্লেষণ করে ফেলতে পারলে মানব সভ্যতার বড় বড় সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমার কানে দাদার সেই বাণী ছিল একরকম ভস্মে ঘি ঢালার সমান। আমার মত এক সামাজিক অর্বাচীন, যার কাছে ‘মানব’ এবং ‘সভ্যতা’ হল বিপরীতার্থক শব্দ, তার কাছে এসব জীবনমুখী কথা বলার কোনও মানে হয় বলুন তো?


এদিকে হয়েছে কি, সম্ভবত, এই অ্যালগরিদমের কারনেই, ফেসবুকে আমার ‘লাইক’ দেওয়া বিদেশী অ্যাডভেঞ্চার এবং ক্লাইম্বিং চ্যানেলগুলো অবিরাম আমাকে দেখিয়ে চলেছে, প্রত্যহ কিসব কাণ্ডটাই না করছেন তাঁদের দেশের এলিট ক্লাইম্বাররা। দেখতে পাচ্ছি, লকডাউন তাঁদের ক্লাইম্বিং স্পিরিটকে দাবায়ে রাখতে একেবারেই অক্ষম। দেখতে পাচ্ছি, কেউ তাঁদের কিচেনের টেবিল-চেয়ার ক্লাইম্ব করছেন, কেউ ফ্ল্যাটের দেওয়াল বেয়ে চিমনি করছেন, কেউ সিঁড়ি দিয়ে এতবার ওঠানামা করছেন যে মাউন্ট এভারেস্ট চড়া হয়ে যাচ্ছে! আর সেই না দেখে ইন্টারনেট জুড়ে পাবলিকের সেকি আহ্লাদের ফোয়ারা! পুরো সুকুমারোচিত স্টাইলে ‘দেখ বাবাজী দেখবি নাকি দেখ রে খেলা দেখ চালাকি’ ইনফাইনাইট লুপে চলছে। 



বুঝুন কারবার! এদিকে আমাদের দেশের মাউন্টেন ক্লাইম্বাররা ভাবছেন জুন মাস থেকে খাবেন কি? ইন্টারনেটে পোস্ট দেবার জন্য ব্যায়ামাদি করলে তো আবার খিদে বেড়ে যাবে। তখন, তাঁরা খাবার পাবেন কোথায়? তাঁদের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজ যাবেন কী করে? শেষে কি ধার-দেনা করতে হবে? তবে, আশার কথা এই যে, একগাদা ‘বসন্ত এসে গেছে’-টাইপ ফুরফুরে হবিইস্ট বাদ দিলে, এদেশে ফুল-টাইম মাউন্টেনিয়ার, অ্যাদ্ভেঞ্চারার নাই বললেই চলে। তাই সেরকম দুয়েকজন অর্বাচীন এসকেপিস্ট না খেয়ে মরলে কাকপক্ষীও টের পাবেনা।


তাই, বুঝলেন, আজকাল মন পারপেচুয়ালি খারাপ থাকে। খারাপ বলতে একেবারে হাউহাউ করে কাঁদার মত, কিংবা, বাড়ির ছাত থেকে ঝাঁপ দেবার মত নয়। কেবল একটা অবসন্ন হতাশা কাজ করে চলে। তবু হাল ছাড়া যায় না। কারণ এমন হতাশা আজ চারদিকে, সমস্যা কারও একার নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, সামুহিক হতাশাও কি একটা সলিডারিটি আনতে পারে? মানুষকে যুক্তিবাদী, ইতিহাস সচেতন, বিজ্ঞানমনস্ক, দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে?  


ধুস, পারে হয়ত, তবে সে অন্য কোথাও, এ দেশে নয়। আপনি যদি ভারতবাসী হন এবং আপনার যদি এই আশা জন্মায় যে এই বিষাদের সংহতি আগামী দিনে কোনও বিপ্লবের জন্ম দিতে চলেছে, সমাজকে বদলে দিতে চলেছে, তাহলে আপনি নির্ঘাৎ দিবাস্বপ্ন দেখছেন, অথবা, আপনার পেট গরম হয়েছে। ভারতবর্ষে আর যাই হোক, কোনও গণ অভ্যুত্থান, কোনও বিপ্লব হবে না। হতে পারে না। আমরা জাত-পাত, পুরুষ-নারী, হিন্দু-মুসলিম নিয়ে থাকব, শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত থাকব। ইতিহাস কখনও মিথ্যে বলে না।


অবশ্য দাদাগো, লোতুন করে ইতিহাস বই লিখলে, মিখ্যাকেও সত্য বলে দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যায়। এতো আকছার হচ্ছে। ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল- মনে নেই? 

    
এই বলে চোখ টিপলুম এবং আজকের মত স্বগতোক্তি শেষ করলুম।       

Photo courtesy : CNN

দেখ বাবাজী দেখবি নাকি


Comments

Popular posts from this blog

Across The Sahara on a Bicycle

To the Mountains of the Moon: A Journey from Fiction to Facts

Straight from a Story Book: Part I