Skip to main content

Tagar Pishir Metaphysics


টগরপিসির মেটাফিজিক্স

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়





হাওড়ায় আমাদের একটা বাড়ি ছিল এখন সেই বাড়ি আর নেই, তবে, শৈশবের সেই পাড়ার গলিঘুঁজি এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে একসময় সেই বাড়ির মূল আকর্ষণ ছিল গঙ্গার ধার ধরে ছবির মত সুন্দর এক পায়ে চলা পথ ছোটবেলার কত যে দুরন্ত দুপুর আর বিকেল, স্মৃতির ধুলো হয়ে ছড়িয়ে ছিল এই পথে, তার ইয়ত্তা নেই সম্প্রতি, প্রায় তিরিশ বছর পরে, এক অদ্ভুত কারণে আবার একবার যেতে হয়েছিল শৈশবের সেই পাড়ায় ইদানীং, আমাদের ছোটবেলার বন্ধুদের একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ হয়েছে সেখানেই খবরটা প্রথম পেয়েছিলাম, সম্ভবত কেষ্টাই লিখেছিল


খবরটা ছিল এইরকম- ‘গোপলা সন্ন্যাসী হয়ে গেছে প্রায় একযুগ হিমালয়ের কোনও একটা গুহায় তপস্যা করার পর, সে নাকি কোনও এক দৈবাদেশ পেয়ে, হরিদ্বারে এক বিরাট আশ্রম তৈরি করেছে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসছে ওর পায়ের ধুলো নিতে গোপলাকে দর্শনকরার জন্য এত ভিড় হচ্ছে যে প্রত্যেক ভক্তকে মাত্র তিনটি করে শব্দ বলার অনুমতি দিতে বাধ্য হচ্ছে গোপলার মন্ত্রশিষ্যেরা বৈদিক পদ্ধতির কোনও এক উচ্চাঙ্গ অংক কষে, সেই মন্ত্রশিষ্যেরা নাকি জানতে পেরেছে, তিনটি শব্দ উচ্চারন করতে, তা পৃথিবীর যে ভাষাতেই হোক না কেন, গড়ে যে সময় লাগে, সেটিই তাঁদের পরমপূজ্য গোপালানন্দ বাবার জন্য অপটিমাল। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত, সৎ-চিৎ-আনন্দ, অ-উ-ম, আমলকি-হরিতকি-বয়রা- সবই যে তিনের খেলা! কাজেই আগত ভক্তদের যা বলার, তা তিন শব্দেই সারতে হচ্ছে। আর ত্রিকালজ্ঞ গুরুদেব, অর্থাৎ, আমাদের গোপলা, সেই তিনের উত্তর দিচ্ছেন একে- একটি মাত্র শব্দে হয়ে যাচ্ছে ভক্তের সমস্ত সমস্যার, সকল জিজ্ঞাসার সমাধান! আর উত্তর দিচ্ছেন ভক্তের কানে কানে। ফলে, যেহেতু, মহাবিশ্বের বীজমন্ত্রগুলি কানাকানি হচ্ছে, সেই মন্ত্রের শক্তি হাওয়ায় উবে যাবার সম্ভাবনা একেবারেই থাকছে না। এসব জ্ঞান কপ্পুরের মত উদ্বায়ী কিনা!


এই পর্যন্ত পড়েই আমি এত অবাক হয়েছিলাম যে পরদিন সকাল পর্যন্ত কারও সঙ্গে একটা কথাও বলতে পারিনি কেষ্টা বলে কি! একসময় যে গোপলাকে গোপালবলে ডাকলে চটে যেত, তার নিজের আশ্রম হয়েছে শুধু নয়, সেই আশ্রমের সিংহদরজায় নাকি নেমপ্লেট বসেছে-‘স্বামী গোপালানন্দ শ্রী শ্রী শ্রী’! ভেবেছিলাম, এইবেলা টগরপিসির সঙ্গে দেখা না করলেই নয়! টগরপিসি, অর্থাৎ, গোপলার বিধবা পিসি ছিলেন গোটা পাড়ারও পিসি টগরপিসি ছাড়া, ছোটবেলা থেকে গোপলার তিনকুলে কেউ ছিল না এমন কি ওর বাড়ির ত্রিসীমানায় আমরা ওর অন্য কোন আত্মীয়কে পা মাড়াতেও দেখিনি গোপলার আত্মীয়স্বজনের ব্যাপারে আমরা কোনদিন কিছু জানতে না চাইলেও, মাঝেমধ্যেই ও তিনসত্যি করে বলত, ‘টগরপিসিই আমার সব রে!’ তিনকুল, ত্রিসীমানা, তিনসত্যি- এখানেও সেই তিনের ত্রিমুখী তান্ডব দেখে সেদিন তাজ্জব লাগছিল তিন নম্বরটা যে এত টেরা, আগে তো কখনও ভেবে দেখিনি! গোপলাকে শেষে তিনে পেল? ব্যাপারটার একটা সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতেই হচ্ছে, এই ভেবে একদিন হাওড়ার বাসে চেপে বসেছিলাম  



জি টি রোড থেকে গোপলার বাড়ি যাবার একটা শর্টকাট ছিল সেদিন বাস থেকে নেমে, সেটা খুঁজে না পেয়ে গঙ্গার ধারের সেই রাস্তাটাই ধরেছিলাম স্বাভাবিকভাবেই, রাস্তাটা আজ অনেক বদলে গেছে, তবু মনে পড়ছিল, এই পথেই একদিন, গোপলা আর আমি, মনুষ্য জীবনের অর্থ এবং উদ্দেশ্য কি, তা জানতে চেয়েছিলাম ব্যাপারটা একটু বেশী দার্শনিক গোছের শোনাচ্ছে? খোলসা করে বলছি, শুনুন তাহলে ছোটবেলায়, গঙ্গার পাড়ের সেই রাস্তাটায় রোজ খেলতে যাবার মূল আকর্ষণ ছিল এক বিশাল অশ্বত্থ গাছ গাছটার বয়স তখনই কত ছিল কে জানে, কিন্তু তার ঝুরি গুলো মাটি অবধি ঝুলত আমাদের খেলা ছিল, সেই ঝুরি ধরে টারজানের মত সুইং করে একেবারে গঙ্গার জলে ঝপাং করে গিয়ে পড়ার গাছের ঝুরি ছেড়ে, যে মুহূর্তে আমাদের শরীরটা শূন্যে উড়ে যেত, তখন একটা শব্দ হত- ‘সুঁই’। কেন জানিনা, সেইসুঁই’-আওয়াজটা শোনার জন্য আমরা সারাদিন অপেক্ষা করতাম, আর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম, আওয়াজের উৎসটা কী- গাছের ঝুরি, না, আমাদের হাত? ঝুরি ছেড়ে হাতটা বেরিয়ে যাবার সময় শব্দটা উৎপন্ন হয়, নাকি, শব্দের জন্ম একটু আগেই হয়, আমাদের কানে আসে একটু পরে? অবশ্য, এই খেলাটা যেহেতু কেবল জোয়ারের সময়ই সম্ভব হত, তাই রোজ বিকেলে সেই খেলাটা হয়ে উঠত না ফলে জোয়ার-ভাটার এবং আমাদের স্কুল ছুটির টাইম টেবিল যেদিন মিলত, সেদিন জমে উঠত সুঁই। সুইং এবং সুঁই এর সন্মিলনে খেলাটার একটা যুৎসই নামও দিয়েছিলাম আমরা- ‘সুঁসিরাজ
 
বাদিবাবু বলে একজনের একটা ছোট্ট ঝুপড়ি চায়ের দোকান ছিল সেই গাছতলায় বাদিবাবু ছিলেন আমার ঠাকুরদার বন্ধু স্বভাবতই আমরা তাঁকে বাদিদাদু বলেই ডাকতাম বাবার কাছে শোনা, একবার সিরাজউদ্দৌলা পালায় আমার ঠাকুরদা হয়েছিলেন আলিবর্দি খাঁ, আর বাদিবাবু আলেয়া মহিলা চরিত্রে অভিনয়ে নাকি বাদিদাদুর জুড়ি মেলা ভার ছিল শীতের বিকেল গুলোয়, গঙ্গা থেকে কাদা মেখে উঠে, মাঝে মধ্যেই আমরা বাদিদাদুর উনুনের ধারে বসে পড়তাম বাদিদাদু তাতে মোটেই বিরক্ত হতেন না, বরং আমাদের কান্ডকারখানা দেখে একটা প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ফুটে উঠত তাঁর চোখেমুখে উনুনের ধারে বসতে পেলে আমাদের দুটি মুখ্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ হত এক, উনুনের আঁচে গা গরম হয়ে যেত এবং আবার একটা সুঁইং করার প্রয়োজন দেখা দিত দুই, নিজেদের সেঁকে নেবার ফাঁকে বাদিদাদুর মুখ থেকে নানান গল্প শোনা যেত আমার এবং গোপলার বাড়ির লোকেরা এই ভেবে নিশ্চিন্ত থাকতেন যে, বাদিদাদু আমাদের ওপর সবসময় নজর রাখছেন ছেলেদুটো গঙ্গায় ডুবে যেতে পারে এইরকম তুচ্ছ দুশ্চিন্তা করা ছাড়াও সেসময় বাবা-মায়েদের অনেক কাজ ছিল তাছাড়া, বেঘোরে ডুবে মরার পাত্র যে আমরা ছিলাম না, তা বাদিদাদু বেশ জানতেন   


যাইহোক, সেরকমই এক ঝুরি ধরে ঝোলাঝুলির বিকেলে, গোপলা হঠাৎ বেশ গম্ভীর গলায় আমায় বলেছিল, বুঝলি রাজা, কিছুদিন ধরে একটা ব্যাপার আমায় খুব ভাবাচ্ছে গাম্ভীর্য এবং চিন্তাভাবনা- এই দুধরণের কর্মক্ষমতা আমাদের আমাদের দুজনের কারও মগজেই ছিলনা, তাই বেজায় অবাক হয়ে জিগ্যেস করেছিলাম, সেটা আবার কি? এরপরের কথোপকথন ছিল অনেকটা এইরকম-

গোপলা-এই সব কিছুর মানে কি?
রাজা-সব কিছু বলতে?
গোপলা- আরে, বুঝলি না, জীবন, মৃত্যু, সংসার, দ্বায়ীত্ব, কর্তব্য- এইসব আর কি!
রাজা(একটু থতমত খেয়ে)- আরে ধুর, এসবের কোন মানে থাকতেই হবে, তার কি মানে আছে?
গোপলা (আরও গম্ভীর হয়ে)- মানে একটা তো থাকতেই হবে তা না হলে চলবে কি করে? মানে না থাকলে এই জীবন তো
রাজা (একটু ভেঙিয়ে)- জীবন তোকী?
গোপলা- চল বাদিদাদুর কাছে যাই       

গোপলার প্রশ্ন শুনে বাদিদাদু কিন্তু একটু মুচকি হেসে বলেছিলেন, বোস ভরসা পেয়ে উনুনের ধারে বসেছিলাম দুজনে বাদিদাদু বলা শুরু করেছিলেন, “মনুষ্য জীবনের একটা উদ্দেশ্য আছে বই কি! ওরে অ্যারিস্টটল কি বাজে কথা বলার লোক ছিলেন রে? বীজের মধ্যেই বিশ্ব থাকে, আমের আঁটি মাটিতে পোঁত, আম গাছই বেরুবে ঠিক কিনা?” এই অবধি শুনেই, গোপলা আর আমি দুজনেই একেবারে ব্যোমকে গেছিলাম তার কারণ, প্রথমত, ‘অ্যারিস্টটলশব্দটা সেই প্রথম শুনছিলাম দ্বিতীয়ত, আমের আঁটি মাটিতে পুঁতলে তা থেকে আম গাছ বেরুবে, এই কথার মধ্যে কী যে বিশেষ জ্ঞান লুকিয়ে আছে তা কিছুতেই মাথায় ঢুকছিলনা আমাদের দুরবস্থা দেখে বোধহয় বাদিদাদুর মায়া হয়ে থাকবে, তাই আমাদের হাঁ-করা মুখের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করেছিলেন, “ও পাড়ার দত্তপিসী কে চিনিস তো?” হাঁ-করা অবস্থাতেই দুজনে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলাম বাদিদাদু গল্প শুরু করেছিলেন, “দত্তগিন্নী একবার তাঁর দুই নাতিকে নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন আমার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হতে জিগ্যেস করেছিলাম, নাতিদের বয়স কত হল? উত্তরে দত্তগিন্নী বলেছিলেন, ‘যে ডাক্তার, তার বয়স পাঁচ, আর উকিলের বয়স এখন সাত আমের আঁটি থেকে আমগাছ, কিছু বুঝলি এবার? একেই অ্যারিস্টটল বলেছিলেন টেলোসঅ্যারিস্টটল, দত্তগিন্নী, টেলোস- কীসব বলছে রে ভাই! নির্ঘাৎ বুড়োর মাথা খারাপ হয়ে গেছে, এই ভেবে আর কথা না বাড়িয়ে দুজনে বাড়ি ফিরেছিলাম আজ বুঝতে পারি, এইভাবেই, একদিন হাওড়ার গঙ্গার পাড়ে, এক অশ্বত্থ গাছের ঝুরি ধরে ঝুলন্ত অবস্থায়, সুইং এবং সুঁই-এর সন্ধিক্ষণে, আমার এবং গোপলার জীবন জিজ্ঞাসা শুরু হয়েছিল তাই সেদিন, প্রায় তিরিশ বছর পর, গোপলার গৃহত্যাগ এবং ত্রিকালদর্শী স্বামী গোপালানন্দ শ্রী শ্রী শ্রী হয়ে তার পুনরাবির্ভাবের খবর শুনে, সেই জিজ্ঞাসা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল গোপলা কি তাহলে সত্যিই মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পেল?

  

গঙ্গার ধারের সেই সরু পায়ে চলা পথটা আর চেনা যাচ্ছিল না। চিনবই বা কি করে, না ছিল সেই অশ্বত্থ গাছ, না ছিল বাদিদাদুর দোকান। মনে হয়েছিল, এতদিনে বাদিদাদু নিশ্চয়ই গত হয়েছেন, তাই দোকানও উঠে গেছে; তাই বলে অশ্বত্থ গাছটা কেটে ফেলা কি খুবই প্রয়োজন ছিল? পাড়ায় ঢোকার মুখটাতেই দুটো পেল্লায় ফ্ল্যাটবাড়ি হয়ে যাওয়ায় কিছুতেই গোপলার বাড়ি যাবার গলিটা চিনতে পারছিলাম না পাড়ার পুরনো বাসিন্দাও কেউ চোখে পড়ছিল না। কয়েকজন পথচারীকে গোপলার বাড়িটা কোনদিকটায় বলতে পারেন’, জিগ্যেস করায়, সকলেই ঘাড় নেড়ে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গিয়েছিল অবশেষে, টগরপিসির নাম বলতেই কাজ হয়েছিল, আমি যথাস্থানে পৌঁছে গিয়েছিলাম দেখেছিলাম, তিরিশ বছরে সব কিছু অনেক বদলে গেলেও, টগরপিসি একদম বদলাননি এবং বুঝতে পেরেছিলাম পাড়ার পিসিখেতাব এখনও তাঁরই

আমাকে দেখেই একেবারে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন পিসি তিরিশ বছর পর দেখা হচ্ছে, তবু একঝলকেই আমাকে কী করে চিনে ফেললেন পিসি, সেটা বুঝে ওঠার আগেই বললেন, ‘গোপলাটার কান্ডটা শুনেছিস রাজা? এত কষ্ট করে, একবেলা নিজে না খেয়ে যাকে মানুষ করলাম, সে কিনা হুট করে একদিন হাওয়া হয়ে গেল?’ আমি সত্যিই খুব অবাক ছয়ে জিগ্যেস করি, ‘বল কি পিসি, তোমায় না বলে কয়ে চলে গেল?’ আমার সেই প্রশ্ন শুনে, একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন টগরপিসি বললেন, ‘শোন রাজা, মায়া, মমতা, স্নেহ, বাৎসল্য এসব আর আমায় দেখাস নি মানুষ যে কি জিনিষ, তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছি বলি, বয়স তো আর কম হলনা তুই যদি এখন আমায় জিগ্যেস করিস হাতিদের চেহারা অমন বিশাল আর বেঢপ, গায়ের রঙ ছাইমাখা, আর চামড়া অমন কুঁচকান কেন? তাহলে আমি কি উত্তর দেব জানিস?’ এই বলে, আমার দিকে কটমট করে তাকালেন পিসি আমি খানিক থতমত খেয়ে কিছু বলার আগেই পিসি বললেন, ‘তাহলে আমি উত্তর দেব, হতভাগা, যদি হাতি ছোট্ট, সাদা এবং গোল হত; তাহলে তার নাম হত অ্যাসপিরিন বুঝলি কিছু? বুঝিস নি, জানি, গোপলার বন্ধু যে! শোন গোপলার দ্বারা সৎ পথে থেকে, পরিশ্রম করে, মানুষের মত বাঁচা যে সম্ভব হবে না, তা আমি অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলাম গোপলা একদিন মানুষের মত মানুষ হবে, এই আশা যে একধরণের flocci-nauci-nihili-pili-fication, তা আমি ওর ছোটবেলাতেই বুঝে গিয়েছিলাম তাই বিএ পরীক্ষায় ফেল করার পর, যেদিন আমার ঠাকুমার রেখে যাওয়া সোনার চেনটা চুরি করে ও হাওয়া হল, আপদ বিদায় হল ভেবে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম এবার হাতি আর অ্যাসপিরিন এর তুলনাটা বুঝলি? হ্যাঁ, বলে আমি ঘাড় নাড়তেই, আমার হাতে দুটো বাতাসা আর এক গ্লাস জল ধরিয়ে পিসি বললেন, ‘আমার সঙ্গে হরিদ্বার যাবি রাজা? গোপলার খোঁজ যখন একবার পেয়েছি, ওর সঙ্গে একবার দেখা করা খুব দরকার ব্যাটা ভেবেছেটা কি? বাবা সেজে বসে থাকবে, আর পিসি ওর নাগালটাও পাবে না!’ সত্যি কথা বলতে কি, পিসির ঠাকুমার সোনার হার চুরির ঘটনাটা শুনে, সেই মুহুর্তে আমিও গোপলার ওপর ভীষণ খাপ্পা হয়ে ছিলাম বলেছিলাম, ‘বল কবে যাবে? এক্ষুনি টিকিট কাটছি আর মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল, টগরপিসির হাতি, অ্যাসপিরিন, আর শেষে floccinaucinihilipilification আমার মনে হচ্ছিল, ইস, ছোটবেলায় ভয় না পেয়ে, টগরপিসির সঙ্গে আরও একটু সময় কাটালে বোধহয় ভাল হত সেই কোন শীতের এক বিকেলে বাদিদাদুর কাছে শোনা দত্তগিন্নীর টেলোসআর এখন টগরপিসির হাতি-অ্যাসপিরিন র‍্যাসনালিজমশুনে, আমার ছোটবেলার পাড়াকে পুরোপুরি মেটাফিজিকাল মনে হচ্ছিল।


ঠিক দুদিন পরের ঘটনা তৎকালে টিকিট করে আমি আর টগরপিসি দুন এক্সপ্রেসে উঠে পড়েছিলাম পরদিন সকালে যখন ঘুম ভেঙেছিল তখন দুন এক্সপ্রেস দুলছিল সেই দুলুনিতে সে চলছে না থেমে আছে বোঝার উপায় ছিল না গতি এবং স্থিতির বোধ ছিল না আমিও জেগে আছি না ঘুমিয়ে তা বুঝতে পারছিলাম না সেই মুহুর্তেসেই গতি-স্থিতির জোট আদপে একটা সমস্যানা পরিস্থিতিতাও বুঝতে পারছিলাম না ব্যাপারটা সমস্যা হয়ে থাকলে তার একটা সমাধান করা দরকারএমন কোন তাগিদও ছিল না অলসেরা যখন কাজ করে নাতখন আলস্য কাজ করে আমার পাশের বার্থে নাক অবধি কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে থাকা টগরপিসি হঠাৎ বলে উঠেছিলেন, ‘রেস্ট আর মোশনকোনটাই অ্যাবসলিউট নয় কেবলই ফ্রেম অফ রেফারেন্স বুঝলিনাবলতে গেলেও ঘাড় নাড়তে হবেআর সেটাও একটা কাজ চরম আলস্যে সেটাও চেপে গেছিলাম ভেবেছিলাম, বুঝিনি বললেই যদি আবার বোঝাতে আরম্ভ করে? তখন আবার সেই হাতি আর অ্যাসপিরিনের গল্পের মত, না বুঝেও বুঝেছি বলতে হবে বেশীক্ষণ অবশ্য সেই ইনারসিয়া টেকেনি পিসির জ্ঞান বর্ষণের সম্ভাবনায় যা হয় নিএক বিচিত্র শব্দ প্রবাহে তা ঘটেছিল জীবন্মৃত বাঙালি, অর্থাৎ আমি, নড়েছিলাম 

নীচের বার্থে প্রবল ফোঁস ফোঁস শব্দে, আলস্য কাটিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতেই হয়েছিল অজগর বা অ্যানাকোন্ডা ঢুকে পড়ল নাকিভারতীয় রেলসবই সম্ভব রাসকিন বন্ডের দিব্যি যাই হোকতাকিয়ে দেখি, সাপ নয়মানুষ নীচের বার্থে দুই ভাই পাশাপাশি বসে, বিপুল উদ্যমে বায়ু ত্যাগ এবং গ্রহণ করছেন না নাকেবলই নাক দিয়ে ত্যাগ আর তাতেই সেই ফোঁস এবং ফোঁস বেশ কিছুক্ষন সেই বায়ু বিনিময় চলার পর এক ভাই চোখ খুললেন অন্য বায়বীয় ভাইটিকে শুধোলেনহ্যাঁ রেশরীরটা কীরকম ঠাণ্ডা হয়ে গেল নাকেন জানিসপোচুর অক্সিজেন নিলি তো গুরুজি বলেছেনপ্রত্যহ জোলির আটা এবং ঘি খাবি আর একঘণ্টা অনুলোম ক্যানসারও সেরে যাবেএই শুনে, টগরপিসি ধড়মড় করে উঠে বসে জিগ্যেস করলেনভাইএই জোলিটি কে? অ্যাঞ্জেলিনা? বিরক্ত সুরে ভাইটি বললেনআনজে- নাকি বলছেন, ওটা নয়, এটা পতন-জোলি শুনে পিসি চোখ কপালে তুলে বললেনতাইআত্মমুগ্ধ পরিতৃপ্তিতে ভাইটি, খানিকটা সম্মতিসূচক ভঙ্গীতেই আবার বায়ুত্যাগ করলেন বুঝলাম এ সাধারণ সর্প নয়ঘুটঘুটানন্দের যোগসর্পও নয়; এ হল ইয়োগা-সর্প টেলিভিশনের পর্দায় প্রথম আবির্ভাবের পুণ্যতিথি থেকেই, দাড়ি গোঁফের দুর্ভেদ্য ঝোপের ফাঁক থেকে যিনি গোটা দেশকে চোখ টিপে চলেছেন, সেই বাবার ইয়োগা-সর্প আমাদের যতই বোঝাতে চাইছেন উনি মস্করা করছেনআমরা ততই ওনাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছি কিন্তু, আমরা যে জীবন্মৃত তাই কেউ কিছুই বলছি না দুন এক্সপ্রেস এবং তার অলস যাত্রীর মত ট্রেন এবং ব্রেন দুটোই দুলছে চলছে না


হরিদ্বার স্টেশন পৌঁছে, একজন টাঙ্গাওয়ালাকে স্বামী গোপালানন্দ আশ্রম যাববলতেই, সে আমাদের বসিয়ে রওনা দিয়েছিল। নতুন বাস স্ট্যান্ডের পাস দিয়ে যে রাস্তাটা গঙ্গার খাল পার হয়ে কনখলের দিকে চলে গেছে, সেই দিকে কিলোমিটার দুয়েক যাবার পর, দূর থেকেই আশ্রমের তোরণ চোখে পড়ল। তোরণ দেখেই টগরপিসির সঙ্গে আমারও মনে একটা উত্তেজনা, যেটা দুন এক্সপ্রেসের বগিতে চাপা পড়েছিল, আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল সদর দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল একজন সুবেশ তরুণ আমি কাছে যেতেই সে প্রশ্ন করেছিল, “বাবার সঙ্গে দেখা করবেন তো? অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে?” আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল, “তুমি কি গোপলার ছেলে?” শুনেই ছেলেটি জিভটিভ কেটে, আকাশের দিকে দুহাত তুলে বলেছিল, “বাবা তো আমাদের সকলেরই পিতা, উনি ওমনিপোটেন্ট, ওমনিপ্রেজেন্ট গোপলা আদৌ পোটেন্ট কিনা, তা জানার কোন আগ্রহ না থাকেলও, আশ্রমের পার্কিং লটের বৈভব দেখে এটুকু তৎক্ষণাৎ বুঝেছিলাম যে, সেখানে প্রেজেন্ট ভক্তকুল মারুতি ওমনি চেপে ঘোরেন না ইতিমধ্যে, সেই সুবেশ তরুণ তার হাতে ধরা আই-প্যাডের দিকে একটু ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলেছিল, “ আপনারা শ্রী শ্রী শ্রী- র পূর্বাশ্রম থেকে আসছেন বললেন, তাই না? আপনারা সত্যিই খুব ভাগ্যবান আপনাদের জন্য পরশু সকালে একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেছে আপনারা ঠিক সময়ে চলে আসবেন কেমন?” এই বলেই সে নিজের কাজে ব্যস্ত হল টগরপিসিকে বললাম, এটি সেই কেষ্টাবর্ণিত মন্ত্রশিষ্যদের একজন মনে হচ্ছে টগরপিসি উত্তরে কিছুই বললেন না, কেবল একটা দাঁত কিড়মিড়ের শব্দ শুনলাম মনে হল দুটোদিন, হরিদ্বারের নোংরা, ঘিঞ্জি রাস্তার ধারে, ততোধিক ঘুপচি দোকানপাটে কচুরি, প্যাঁড়া, লস্যি খেয়ে দিব্যি কেটে গেল অবশ্য, যে জাতির কাছে একটি প্রাণীর মল-মুত্র সবই অতীব পবিত্র, যার লেজ ধরে থাকলে তবেই বৈতরণী পার হওয়া যায়; তাদের তীর্থস্থানে এটাই তো কাঙ্ক্ষিত পরমার্থ যাই হোক, দুদিন কেটে গেল, যথাসময়ে আমরা দুজন আবার হাজির হলাম গোপালানন্দ আশ্রমে, যদিও দাঁতে দাঁত চেপে পিসি বললেন, গোপলার ডেরা


দূর থেকে আমাদের আসতে দেখেই কাছে এগিয়ে এলো প্রথম দিনের সেই সুবেশ ছেলেটি। ভিজিটার্স লাউঞ্জ গোছের একটা হলঘরে অপেক্ষা করতে বলে, ছেলেটি একটা ভারী পর্দা ঠেলে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলসেই ঘরে, বাবার দর্শন প্রতীক্ষায় বসে থাকা আরও অন্তত বিশ জোড়া চোখ আমাদের দিকে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে ছিল কয়েক মিনিট পরেই, সেই ছেলেটি এসে আমাদের দুজনকে অন্দর মহলে নিয়ে গেল আবার একটা ছোট উঠোন, আর তার একপ্রান্তে আর একটা দরজা আমাদের দুজনকে সেই দরজার দিকে এগিয়ে যেতে ইসারা করে ছেলেটি বলল, “মনে রাখবেন, তিনটির বেশী শব্দ নয় বাবার সামনে”, তারপর মৃদু হেসে আবার সদর দরজার দিকে ফিরে গেল


পাল্লায় একটা মৃদু চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল এয়ারকন্ডিশন্ড ঘর, মাটিতে পুরু গালিচা, বাতাসে মৃদু রুম-ফ্রেশনারের সুবাস, একটা হালকা স্নিগ্ধ আলো-সব মিলিয়ে এক হিপনোটিক পরিবেশ আমি আর টগরপিসি একপাশে নিঃশব্দে বসে পড়লাম আধো অন্ধকারে চোখ সয়ে যেতেই বুঝতে পারলাম আরও জনা দশেক মধ্যবয়স্ক মানুষ বসে আছেন গালিচার ওপর একটু পরেই অন্য একটা দরজা দিয়ে যে ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন তাকে চিনতে আমার ঠিক তিন সেকেন্ড সময় লাগল একটা হালকা গোলাপি ফিনফিনে পাঞ্জাবী, সিল্কের উত্তরীয়, ধাক্কা পাড়ের ধুতি, কপালে চন্দনের তিলক, আর ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাসি নিয়ে ঘরে পা রাখলেন ত্রিকালজ্ঞ স্বামী গোপালানন্দ শ্রী শ্রী শ্রী মুখের দিকে তাকাতেই চিনতে পারলাম, অবিকল সেই মুখ, কেবল গাল দুটো যেন একটু ফুলে গেছে, আর পেটটা অনেকটা নধর হয়েছে গোপলার গোপলা ঘরে পা রাখতেই, ভোজবাজীর মত, কোথা থেকে যেন একটি বিচিত্র দর্শন ছোকরার উদয় হল সে গোপলার হাত ধরে একটা সিংহাসন গোছের চেয়ারে বসিয়ে দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল। বুঝলাম, হল গোপলার ব্যক্তিগত সেবক এদিকে সিংহাসনে বসে গোপলা আধ-খোলা চোখে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে লাগল আমি দেখলাম, সেই মুহূর্তে, ঘরের সকলের ভক্তিমাখা দৃষ্টি গোপলার মুখে নিবদ্ধ, আর টগরপিসি একদৃষ্টে চেয়ে আছেন গোপলার গলার দিকে টগরপিসির দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই চমকে উঠলাম আমি গোপলার গলায় ঝুলছে একটা সুন্দর সোনার চেন একটা মৃদু ঘর্ষনের আওয়াজ পেয়ে আড় চোখে তাকাতেই বুঝলাম, উত্তেজনায় টগরপিসি আবার দাঁত কিড়মিড় করছেন আমাদের পরমপূজ্য পিতার পূর্বাশ্রম থেকে যে দুজন এসেছেন, তাঁরা সবার আগে দর্শন সেরে নেবেন পিতা আজ একটু আগেই ধ্যানে বসবেন কিনা”, সেবকের মিনমিনে কন্ঠস্বর শোনা গেল সেবক আরও বলল, “তবে মনে রাখবেন তিনটির বেশী শব্দ উচ্চারণ যেন না করা হয় টগরপিসি গোপলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন পিসির গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম আমি গোপলার দৃষ্টি তখনও দেওয়ালে। প্রথম মুখ আমিই খুলব ভেবেছিলামগত দুদিন ধরে আকাশ-পাতাল ভেবে আসছিলাম তিন শব্দে কী বলা যায় গোপলাকে! একবার ভাবি, ‘সত্যম, শিবম, সুন্দরম’ বল, তো আরেকবার মনে হয় বলি, ‘অমর, আকবর, অ্যান্টনি’। এই দুটো ছবিই গোপলা আর আমি একসময় স্কুল পালিয়ে দেখেছিলাম কি না। যাইহোক, সেই মুহুর্তে, আমার শব্দের ত্রিফলা দানা বাঁধার আগেই দেখি গোপলা আর টগরপিসি একেবারে মুখোমুখি ঠিক দুহাত ব্যবধানে টগরপিসিকে দেখে গোপলার তখন চক্ষুস্থির ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা স্মিত হাসি হাওয়া, বরং স্পষ্ট এক হতভম্ব ভাব তার মুখে কয়েক সেকেন্ড এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল গোটা ঘরে তারপর, এক অসম্ভব গম্ভীর, কিন্তু ধারালো কন্ঠস্বরে টগরপিসি উচ্চারণ করলেন তাঁর বরাদ্দের তিনটি শব্দ- “গোপলা, তুই চোর


###

Comments

Supriya Dolui said…
অসাধারণ,গল্পের সমাপ্তিটা। গল্পের মাঝের দু-একটি জোকস বেশ ভালো ছিল। গল্পটা পড়ে,বাবার বলা তার শৈশবের কাহিনীও মনে এসে গেল। ❤❤
Asim Moulik said…
সুন্দর ছোটো গল্প।
Unknown said…
ছুটির দিনে এক জমাটি গল্প পেলাম। ধন্যবাদ।
Unknown said…
অসম্ভব ভালো লাগলো।লিলা মজুমদারকে মনে করালেন।

Popular posts from this blog

Across The Sahara on a Bicycle

Across The Sahara on a Bicycle Between the things we get And the things we celebrate Flows a desert                            Lest we forget. #SaharaQuartet Background: My Africa My first exposure to the real Africa in 2005 after climbing Kilimanjaro. Scanned from slide. On top of Kilimanjaro in 2005 with a copy of Tathyakendra magazine. Scanned from slide I first visited Africa (Tanzania to be specific) in 2005. I hiked Kilimanjaro and came back home. It was just a tourist thing I did. But in spite of being wrapped up in an itinerary and a travel package of all things touristy; something very curious happened. I got even more inquisitive about Africa. I wanted to go back to Africa. Not as a tourist, but as a drifting wanderer, living an ever curious life. But for that I had to wait a good seven years. In 2011, while I was exploring the barriers of the Nanda Devi Sanctuary in ...

To the Mountains of the Moon: A Journey from Fiction to Facts

In 1937, Bibhutibhushan Bandyopadhyay chronicled the adventures of a Bengali boy named Shankar. This novel was named 'Chander Pahar' (English: 'Mountains of the Moon', as the fiction refers to a range of mountains and not a single standing mountain). 'Chander Pahar' went on to become one of the most loved adventure stories in the Bengali literature. In his lifetime, Bibhutibhushan wrote 16 novels and over 200 short stories. Interestingly, even though most of Bibhutibhushan's works were largely set in rural Bengal; in this particular novel the writer chose the setting of 1909 Africa. Bibhutibhushan Bandyopadhyay (1894-1950) In the story 'Chander Pahar', our protagonist Shankar gets a lucky break to go out from his little riverside village in Bengal to work for the Uganda Railway. Thus begun his sudden and long journey from the mundane to the extraordinary. A roller coaster ride through adventures involving the infamous man eating lions of Tsav...

Straight from a Story Book: Part I

It all started with a story book. In 1937, Bibhuti Bhushan Bandyopadhyay , one of the leading writers of modern Bengali literature penned ' Chander Pahar '. It is a story of a 22 year old young man from rural Bengal who sets out to Africa on an adventure of a lifetime in 1909. (If you have not read the book already you can read the plot summary here: https://en.wikipedia.org/wiki/Chander_Pahar ) Like millions of Bengali readers I had read this adventure story when I was a kid and then as I grew up, as indicated by its publisher (juvenile literature); it became a thing of the past, a childhood fantasy for me.  It is only in recent years, after I climbed Kilimanjaro (2005), I picked up 'Chander Pahar' again. It is then, the book started opening new meanings and fresh directions for me. It is then I began to understand the meaning of the Swedish proverb- 'In a good book the best is between the lines' .  My repeated readings of 'Chander Pah...