ব্রেজিলের বিচ্ছু
|
হুয়ারাজের সেই সেভিচেরিয়া , ছবিঃ লেখক |
২০১৮। আন্দিজ পর্বতমালার যে অংশ পড়েছে পেরুর ভাগ্যে, সেই
পাহাড় শ্রেণীর নাম ‘কোর্দিয়েরা ব্লাঙ্কা’। সেখানে যেমন রয়েছে অপূর্ব সুন্দর কিছু শৃঙ্গ,
তেমনই রয়েছে পর্বতারোহনের অন্যতম দূর্গম কয়েকটি চ্যালেঞ্জ। ইতালিয়ান অ্যাল্পাইন
ক্লাবের আমন্ত্রণে, কোর্দিয়েরা ব্লাঙ্কা-র কঠিনতম ‘উয়ানসান’ শৃঙ্গে অভিযান শেষে
আমি একলা পথ ধরেছিলাম। প্রায় একমাস ধরে, আমরা কয়েকজন পর্বতারোহী, উয়ানসানকে
ক্লাইম্ব করার লক্ষ্যে স্থির থেকে লড়াই চালানোর পর বুঝতে পেরেছিলাম কেন তাকে
‘আন্দিজের কে-টু’ বলা হয়। পাহাড়ের চুড়ায় উঠে দাঁড়াতে না পারার কোন আক্ষেপ ছিল না।
বরং ছিল, এক স্বাবলম্বী ক্লাইম্বের বিশুদ্ধ আনন্দ। বেসক্যাম্পে আমার ইতালিয় এবং
কেচুয়া বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে, পিঠে নিজের রুকস্যাক তুলে হাঁটা দিয়েছিলাম।
উদ্দেশ্য, হাতে যেটুকু সময় বেঁচে ছিল তা কাজে লাগিয়ে পেরু দেশটাকে একটু দেখে
নেওয়া।
|
উয়ানসান বেস ক্যাম্প থেকে ফেরার পথে কেচুয়া ঠাম্মা। দেশ দেখা শুরু। তার আগে অবধি পাহাড় চড়া চলছিল। |
প্রথমে একটা লম্বা হাঁটা, তারপর কিছুটা হিচ-হাইক করে দিনের শেষে পৌঁছে
গিয়েছিলাম অপূর্ব সুন্দর শহর হুয়ারাজ। সন্ধ্যায় হাঁটতে বেরিয়ে এক সেভিচেরিয়ায় আলাপ
হয়েছিল মায়া এবং সিসকোর সঙ্গে। পাহাড়তলির শহর হুয়ারাজের
ব্যস্ত এই রেস্তোরাঁয় এই দুজনের মুখ একেবারে অন্যরকম মনে হয়েছিল। স্থানীয়
কেচুয়াদের মত একেবারেই দেখতে ছিল না তারা, উল্টে অনেকটা যেন আমাদের গ্রাম বাংলার
কোন নদীর পাড়ের মানুষ মনে হয়েছিল তাদের। মজার ব্যাপার হল, একই ঘটনা ঘটেছিল মায়া
এবং সিসকোর সঙ্গেও। ওরাও বেশ অবাক হয়েই তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। কয়েক মুহুর্তের
অস্বস্তি কাটিয়ে উঠে সিসকোই আমার দিকে আলাপের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমার বাড়ি ভারতে শুনেই একরকম লাফিয়ে উঠেছিল দুজনে। ওদের উত্তেজনা দেখে আমার অবাক লেগেছিল। মায়া বলেছিল, বরফের
মধ্যে থেকে পুড়ে গেছ। এবার আমাদের সঙ্গে চল। বলেছিল, আমাদের বাড়িটা আসলে একটা
ভেলা। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছ, নদীর ওপরই শোবে, স্নান করতে ইচ্ছে হলে সটান জলে ডাইভ
দেবে, আর খিদে পেলে জাল ফেলব- কতরকম যে মাছ ওঠে তার ইয়ত্তা নেই। মাছ খাও তো?
|
হুয়ারাজের মাছের বাজার |
আমি একরকম হাঁ করেই ওদের
কথা শুনছিলাম। ওরা নিজেদের পেরুরই বাসিন্দা বলছে, আবার এরকম এক নদীর জীবনের গল্প
শোনাচ্ছে- ব্যাপারটা কি? আন্দিজ পাহাড়, চাভিন, মোচে, ইনকা সভ্যতা, নাজকা লাইনস, মাচু-পিচু, কন-টিকি
অভিযান, পনচো পরা কেচুয়া মানুষের গ্রাম- এই সব এতদিন পর্যন্ত মনের ক্যানভাসে কোলাজ
হয়ে ছিল।
কিন্তু, এ আবার কী বলছে? তাই জিগ্যেস করেই ফেলি, পেরুতে এরকম জায়গা আছে নাকি? আমার
মৃদু অবিশ্বাস দেখে এবার সিসকো বলে, আছে মানে? আমাদের বাড়ি ইকিতোস, অ্যামাজন নদীর
ধারে। লিমা থেকে কোন গাড়ির রাস্তা নেই ওখানে পৌঁছনোর। একমাত্র পথ উড়োজাহাজ।
ইকিতোস-কে তুমি দ্বীপও বলতে পার, আবার শহরও বলতে পার, বলেই হাহা করে হেসে উঠেছিল
সিসকো।
|
মায়া এবং সিসকোর সঙ্গে লেখক |
অ্যা-মা-জ-ন, বিস্ফারিত আমার চোখ, সে তো স্বপ্নের মত এক ব্যাপার! বল কি?
তোমরা অ্যামাজনের মানুষ! এক নিশ্বাসে বলেছিলাম আমি। আমার উত্তেজনা দেখে এবার কেবলই
মুচকি হেসেছিল মায়া এবং সিসকো। আর বলেছিল, ভেবে দ্যাখো, যাবে কি না? এখনও সময় আছে।
সেরকম হলে, আগামীকাল আমাদের সঙ্গে তোমারও একটা টিকিট কেটে নেব। বেসক্যাম্প ছেড়ে
বেরিয়ে আসার মুহূর্ত থেকে আমার মাথায় জেদ চেপেছিল যে, লেক টিটিকাকা এ যাত্রায়
দেখবই। তাই হুয়ারাজের সেই সন্ধ্যায়, অ্যামাজন থেকে আসা এক অযাচিত আমন্ত্রণকে
মুলতুবি রেখেছিলাম। বলেছিলাম, যদি আবার কখনও আসি দক্ষিণ আমেরিকা, তবে একমাত্র
অ্যামাজনের জন্যেই আসব। তখন তোমাদের ভেলাতে থাকতে দেবে তো? অবশ্যই, সমস্বরে সম্মতি
জানিয়েছিল আমার নতুন দুই বন্ধু। ইতিমধ্যে, টেবিলে জড়ো হয়েছিল পেরুর
বিখ্যাত বিয়ার কুজকেনা, সঙ্গে কাঁচা মাছ আর অক্টোপাসের সেভিচে।
|
দূরে লেক টিটিকাকা |
২০১৯। মায়া এবং সিসকোর
সঙ্গে শেষবার কথা হয়েছিল ২০১৮র বড়দিনের সময়। কয়েকদিন আগে হোয়াটসঅ্যাপে হঠাৎ মায়ার
মেসেজ এল। কোমো এসতাস, অর্থাৎ, কেমন আছ ইত্যাদির পরই কথা উঠল আগুনের। মায়া লিখল,
মালোগ্রামোস তোদো, আমরা সব কিছু ধ্বংস করে দিচ্ছি। এত লজ্জা রাখব কোথায়? আমার জবাব
দেবার কিছুই ছিল না। ব্রেজিলের বিচ্ছু এবার বাস্তবে দেখা দিয়েছে এবং বিপদ কেবল
সেখানেই থেমে নেই। একই ধরনের লোভী এবং সর্বগ্রাসী নেতা বিশ্বের সব প্রান্তেই মাথা
চাড়া দিচ্ছে। পৃথিবীর অরণ্য ধ্বংসের উৎসবে রাশিয়া, পোল্যান্ড, মেক্সিকো, পাপুয়া
নিউ গিনি, সুদান, নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভারত- কেউ থেমে নেই। এই
মুহুর্তে অ্যামাজনে, দাবানল নয়, মানুষ আগুন লাগাচ্ছে। সরকার নেভাতে চাইছে না। অ্যামাজনের কথা বাদ দিলে, অরণ্য ধ্বংসের মহোৎসবে যেখানে আগুন লাগানো হচ্ছে না, সেখানে অন্য পদ্ধতি নেওয়া হচ্ছে। বনবাসী-আদিবাসীদের উচ্ছেদ সেইসব জায়গায় তাদের প্রথম পদক্ষেপ। মধ্য আফ্রিকায় পিগমি বাটোয়া, পূর্ব আফ্রিকায় মাসাইদের
মত, এই ভারতেও ১০ লক্ষের বেশী বনবাসীর উচ্ছেদ পরোয়ানা জারী হয়ে গেছে। মানুষের মৌলিক চাহিদাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে বানিজ্যিক লোভ। অ্যামাজনের বৃষ্টিবন
তাই আমাদের কিছুই বলতে চাইছে না। কারণ, বৃষ্টিবনেরা কখনই কিছু বলে না। কারণ, তারা
জ্বলছে না, তাদের জ্বালানো হচ্ছে। আজ তাই মনে হচ্ছে, হুয়ারাজের সেই সন্ধ্যায়,
অ্যামাজনের আমন্ত্রণ এড়িয়ে যাওয়াটা সম্ভবত খুব ভুল হয়ে গিয়েছিল।
|
Image Courtesy: Wall Street Journal |
Comments