একটি অসংলগ্ন স্বগতোক্তি কিংবা মৃত্যু সংলাপ
লেখকের মন্তব্যঃ
লেখাটি মে মাসের তথ্যকেন্দ্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মাননীয় সম্পাদক মহাশয়ের অনুমতি নিয়েই এবার ব্লগে তুলে দিলাম। ২০১০ এ গঙ্গোত্রি হিমবাহে একটি
অভিযান চলার সময় এক বিচিত্র দূর্ঘটনায় পড়ি আমি। হিমবাহের একেবারে শেষ প্রান্তে তখন
আমার তাঁবু। প্রাণে বাঁচতে সেই ক্যাম্প থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নীচে নেমে আসা ছাড়া
পথ ছিল না। কিন্তু বাদ সাধছিল আমার শ্বাসযন্ত্র। অতি দ্রুত সে ভর্তি হয়ে আসছিল
তরলে। প্রাণ বায়ুতে টান পড়ছিল। আমার এবং আমার সহযাত্রীর ধারনা হয়েছিল ব্যাপারটার
পোশাকি নাম ‘পালমনারি ইডিমা’। কিন্তু পরে, কলকাতায় চিকিৎসাধীন হবার পর জানা যায়
সমস্যাটির আসল স্বরূপ এবং অগ্রজপ্রতিম ডঃ রূপক ভট্টাচার্যের ‘হস্তক্ষেপে’ (আক্ষরিক
অর্থেই) সে যাত্রা প্রাণ বাঁচে। জানা যায় ফুসফুসে নিছক জল জমা নয়, আমার হয়েছিল
‘হাইডাটিড সিস্ট’। তবে নিশ্চিন্ত থাকুন, সেই রোগের দুর্ভোগের বিশেষ বিবরণ এখানে আজ
আপনাদের শোনাব না। হিমবাহের সেই ক্যাম্প থেকে গঙ্গোত্রীর আপাত নিরাপত্তায় পৌঁছতে
আমার লেগেছিল মোট ছ’দিন। এখানে তার কয়েক ঘণ্টার একটি ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।কিছুটা পুরনো কাসুন্দি হলেও মৃত্যুর ঝাঁঝ এখনও কমেনি।
১ মৃত্যু
শব্দ যখন কেবলই কান পেতে শোনা যায় তখন বুঝে নিতে হয় তা
কোনও গভীর দুরত্ব থেকে আসছে এবং তার একটা নিজস্ব গাম্ভীর্য আছে। তখন সে আর নিছক শব্দ নয়। তখন সে এক সঙ্গীত। তখন সে এক অশ্রুতপূর্ব স্তোত্র। এক বার্তাময় সত্য। তখন সে কিছু বলতে চায়। প্রশ্ন একটাই, তুমি শুনতে
পাও কি? কারণ, সেই মুহুর্তে, সেই ক্লান্ত প্রশান্তির অবসরে; সেই বার্তা শুনতে পাওয়া হয়ত খুবই জরুরী। আমি পাচ্ছিলাম। বরফ এর আয়না ঠিকরে বেরোনো রোদে ঝলসে গিয়ে, বাতাসে অক্সিজেনের অপ্রতুলতায় একেবারেই বেদম হয়ে গিয়েও; আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। একটা চলমান
বিন্দু ক্রমেই নিশ্চল হয়ে আসছিল। একটি প্রাণ
নিঃস্পন্দ হয়ে আসছিল। একজন মানুষ
নিস্বর্গের একটি অংশে পরিণত হচ্ছিল।
˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜
গঙ্গোত্রী হিমবাহের উপরি অঞ্চল। হিমবাহের সীমান্তে চৌখাম্বা শিখর। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল আমার পর্বত অবতরণ। |
নিশ্চল একটা পাথরের মতই পড়ে ছিলাম এক প্রশস্ত হিমবাহের
বুকে। নিঃস্পন্দ না হলেও নিশ্চল। নিদ্রিত
না হলেও নির্বিকার। হিমবাহ! সে তো প্রতি
মুহুর্তে কয়েক লক্ষ টন ভার বয়ে চলে নিজের শরীরে। দশ তলা বাড়ির মত বিশাল পাথরকে গুঁড়িয়ে করে দেয় বালি, কঠিন বরফ পিষে জন্ম দেয় নদীর। একটা মানুষের
শরীর তাহলে কত অনায়াসেই না মিশে যাবে তার বিস্তারে! হিমবাহে তুষার ঝড়ে পথ হারানো, কিংবা অ্যাভালাঞ্চে
চাপা পড়া মানুষের মৃতদেহ তো আমার পরিচিত। ধাপে ধাপে ভাবতে থাকি। প্রথমে মারা
যাব আমি, তারপর হিমবাহের নিজস্ব গতিতে এই শরীর
গিয়ে পড়বে আমার পাশের এই ক্রিভাসের গহ্বরে। আমার দেহ খুঁজে পাবে না কেউ। তারপর সেই
গোমুখের গুহা থেকে বিন্দু বিন্দু জল হয়ে নদী হয়ে যাব আমি। আমায় গণ্ডূষ ভরে পান করবে কোন তীর্থযাত্রী। কৃতাঞ্জলি হয়ে দেবে সূর্যার্ঘ্য। এটা কি খুব
খারাপ প্রস্থান? মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে আসে আমার সবথেকে
কাছের জনেদের কথা ভেবে। ওদের পরিষ্কার
দেখতে পাই আমি। ওদের বোঝাই
আমি ওদের ভালবাসি। ওদের বলি
শক্ত, সংযত থাকতে। ওদের বলি আমায় ভুল না বুঝতে। ওদের বলি, তোমরা শুনতে পাচ্ছ না, তবে আমি পাচ্ছি। আমার মৃত্যুর
আগাম সংকেত। এক প্রশান্ত, গভীর তন্ত্রীতে বাঁধা তার সুর। তোমরা যাও। আমায় শুনতে
দাও।
˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜
গঙ্গোত্রী হিমবাহের সর্ব্বোচ্চ অবিজিত শৃঙ্গ জাহ্নুকোট |
শব্দটা উঠে আসছিল একটা গভীর ক্রিভাস থেকে। নীলচে বরফটা যেখানে গিয়ে হঠাৎ নিকষ অন্ধকার হয়ে গেছে; তারই কোন না দেখা বিন্দু থেকে সেই শব্দ ভেসে আসছিল। আমি শুনছিলাম আর ভাবছিলাম,এ খুব পরিচিত সুর আমার! আগে কোথায়
যেন শুনেছি? মন স্থির হয়ে আসে। সব সত্য স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। এতদিন সে ছিল আমার কল্পনায় কিংবা দুঃস্বপ্নে। তবে, আজ এই মুহুর্তে যা শুনছি; তা কি সত্যি? এ আমার মৃত্যুর
গান। আজ এখানেই আমার আমি শেষ। প্রতি মুহুর্তে হাল ছেড়ে দিতে চায় আমার শরীর। ডুবে যায় এক
অস্ফুট আরামে। শরীরের সব কষ্ট লোপ পেয়ে যায়। উঠে
দাঁড়ানো দূরে থাক, চোখ খুলে রাখাও সেই মুহুর্তে অপ্রাসঙ্গিক এক বাহুল্য মনে হয়। তবু একসময়, সেই গভীর শব্দ আমার চেতনায় এক অদ্ভুত অনুরণন সৃষ্টি করে। বিচিত্র সেই শব্দ প্রবাহের এক গোপন তরঙ্গে বেজে ওঠে জীবনের সুর। নিজের
অজান্তেই আমি মনকে বলি, উঠে দাঁড়াতে হবে, এগিয়ে চলতে হবে। মনকে বলি, চোখ খোল। নচেৎ
মৃত্যু সঙ্গীত আজ নিশ্চিত।
˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜
চোখ খুলতেই অনেক আলো, অনেকটা আকাশ। সেই আলোয় চোখ সয়ে
যেতেই দেখা দেয় অনেক গুলো চেনা মুখ। আমাকে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। ওদের আমি
চিনি। ওদের নাম, উচ্চতা, এবং ওদের নিয়ে মানুষের লেখা ইতিহাস আমার জানা। ভাগীরথী, খর্চাকুন্ড,
মান্দানি, চৌখাম্বা, স্বচ্ছন্দ এবং জোড়া শিখর নিয়ে শিবলিঙ্গ। ওরা পর্বত শিখর। ওদের
প্রাণ নেই। আছে কেবল আরোপিত দেবত্ব, কল্পিত মহত্ব। আমার
মৃত্যুতে ওদের ভ্রূক্ষেপ মাত্র হবে না। অথচ ওদেরই অমোঘ আকর্ষণে বারবার ফিরে আসি
আমি। ঠিক যেমন এবার এসেছিলাম জাহ্নুকোট নামের শিখরে। গঙ্গোত্রী হিমবাহ অঞ্চলের শেষ
অবিজিত শিখর এই জাহ্নুকোট। বাইশ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতার এই
শৃঙ্গ তার দুর্গমতায় বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে বিশ্বের বহু অভিযাত্রী দলকে। অভিযানের
শর্তাবলী মেনেই এগিয়ে চলছিলাম আমরা। আমরা বলতে পাঁচ জনের ছোট একটি দল। পথ খোঁজার
জন্য দুদিন আগে এগিয়ে ছিলাম আমি। সঙ্গী এক শেরপা বন্ধু। হঠাৎ, সব ওলটপালট হয়ে গেল
এক রাতে। শুরু হল কাশির দমক, সঙ্গে শ্বাস কষ্ট। প্রাণ বায়ু, বায়ু প্রাণ। তাতেই পড়ল
টান। আমি ভাবলাম, পালমোনারি ইডিমা হল বুঝি। উপসর্গ সব কেমন যেন একই রকম। ফুসফুসে
জল? এবার তাহলে পালাই চল। হিমবাহের একেবারে শেষ প্রান্তে তখন আমার ক্যাম্প। হাই
আল্টিচিউড থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নেমে চলাই বেঁচে থাকার একমাত্র মন্ত্র। সেই মত
চলাও শুরু করেছিলাম। কিন্তু, কিছুদূর যেতেই শরীরের সমস্ত শক্তি যেন কোথায় উধাও হয়ে
গেল। দশ পা চলার পর আধ ঘন্টা বিশ্রাম, তারপর আবার দশ কদম। তারপর ঘন্টা, মিনিট, সকাল, দুপুর; সব হিসেব
কোথায় যেন হারিয়ে গেল। চরম ক্লান্ত, অবসন্ন আমি পিঠ থেকে রুকস্যাক খুলে ফেলে একটা
পাথরের ওপর নিজেকে বিছিয়ে দিলাম। সময়ের হিসেব লোপ পেল। গভীর হতে ভেসে এল সেই প্রাণ
অবশ করা সুর।
˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜
২ লাফ
আমার শরীর এক জায়গায় পড়ে থাকলেও শক্তি সর্বত্র ছড়িয়ে
ছিল। ব্যবহৃত জিনিষপত্র যেমন ছড়িয়ে থাকে এক চরম অগোছালো ঘরে, ঠিক
সেইরকম। বেঁচে থাকায় নিজেরই এত অনাগ্রহ আর আলস্য? নিজেকে বিদ্রূপ করতে খুব ইচ্ছে
করছিল আমার। তবু ইচ্ছে গুলো হাল ছাড়তে চাইছিল। আমারই শরীর, অথচ তাকে
আমার থেকে পৃথক মনে হচ্ছিল। তাকে বললাম উঠতে হবে। মারা তো যাবই, তবে আজ নয়; এভাবে
নয়, এখানে নয়। আবার পিঠে রুকস্যাক তুলতে হবে। চওড়া ফাটল গুলো লাফিয়ে পার হতে হবে।
তারপর ঐ যে দূরে দেখা যাচ্ছে পাথরের ঢাল, সেটা বেয়ে একটু একটু করে নিজেকে তুলে
নিয়ে যেতে হবে। আর তারপর, সরু পাঁচিলের মত মোরেনের মাথা বরাবর কয়েক ঘণ্টা নেমে
চলতে পারলে পৌঁছনো যাবে এক চিলতে ঘাসের ময়দানে। সেখানে রয়েছে একটা তাঁবু। আমার মনে
ভেসে ওঠে সেই সবুজ তাঁবু আর তার ভিতরের উষ্ণতার ছবি। ভাবি, যে করে হোক পৌঁছতেই হবে
আজ। কিন্তু লাফানোর মত শক্তি কোথায়? উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাই যার লুপ্তপ্রায়, সে দেবে
ক্রিভাস পেরিয়ে লাফ!
˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜
দীর্ঘ, বিস্তৃত
গঙ্গোত্রী হিমবাহ। চব্বিশ,নাকি ছাব্বিশ কিলোমিটার কে যানে? ভাবি, গ্লেসিয়ার গুলো গলে সংকুচিত হয়ে
একসময় অদৃশ্য হয়ে যাবে। তাদের
নাম উল্লেখের প্রয়োজন ফুরোবে পাঠ্য পুস্তকের পরবর্তী সংস্করণে। সুর্যের দিকে আবার
একবার তাকাই আমি। উষ্ণায়ণের দাপটে ধ্বংসের বিশ্বায়ন আজ। বড় হবে চোরা ফাটল, ক্রিভাস;
আরও দূরে চলে যাবে নিশ্চিত নিরাপত্তার বিন্দুগুলি। এক নিকষ কালো অবিশ্বাসের মতই
আরও বিস্তৃত হবে শূন্য। আমার সবাই হব ‘নেই’ সাম্রাজ্যের যুবরাজ। কত কিছুই তো
হারিয়ে গেছে, আজও অনাহার আর অপুষ্টিতে প্রতিদিন শেষ হচ্ছে জীবন লক্ষ শিশুর প্রাণ।
আর এ তো নিছক প্রাণহীন এক বেয়াড়া হিমবাহ! তাই হিমবাহ হারিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়বে না পৃথিবীর।
আর হিমবাহই যদি না থাকে তাহলে কিসের ক্রিভাস? বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে আমার মুখে। এই
যে হিমবাহ, যে আমাকে মৃত্যুর সঙ্গীত শোনাচ্ছিল এতক্ষণ, তারও মৃত্যু ঘন্টা বেজে
গেছে। শুনছো ক্রিভাস, তুমিও আমার মতই মৃত। তোমায় ভয় পাই না আমি।
সেই মুহুর্তে হই ভাবনা
বিহীন। আমি সেই মুহুর্তে হই জীবন। আমি হতে পারি ক্ষুদ্র, নগন্য; তবে শক্তি আমারই
বা কম কিসের? যে শব্দ শুনিয়েছিল মৃত্যুর আগমনী, সেই শব্দই আমার সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়।
গুন গুন করে এক বিচিত্র গান গেয়ে উঠি আমি। তার সুর, শব্দ সবই আমার অচেনা। তবু সেই
সুরে বাজি আমি। আমি কি উন্মাদ হয়ে গেলাম? আমি উঠে দাঁড়াই। পিঠে তুলি রুকস্যাক।
ওটাকে পাথরের মত ভারী মনে হয়। পা টেনে টেনে আমি ক্রিভাসের দিকে এগোই। লাফ দেবার
একটা যুতসই জায়গা খুঁজতে হবে। এমন একটা জায়গা আমার চাই যেখান থেকে লাফ দিলে
অনায়াসে আমি পৌঁছতে পারব ক্রিভাসের অন্য পাড়ে। এমন একটা জায়গা যেখান থেকে লাফ
দেবার সময় সেই জায়গাটাই ভেঙে পড়ে যাবে না। এমন একটা বিন্দু চাই যার ঠিক উল্টো
দিকেই আমি পাব নিরাপদ ‘ল্যান্ডিং স্পট’। যে ল্যান্ডিং স্পট আমার ভরবেগ সামলাতে
পারবে। ডিহাইড্রেসন, উচ্চতা আর ফুসফুসের অজানা ব্যাধির আক্রমণ সামলে বেঁচে থাকার
এক অসম সংগ্রাম কে এবার যেন একটু স্নেহের চোখে দেখে কেউ অলক্ষ্যে। আমিও যেন কথা
বলি কার সঙ্গে। বলি, এই লাফটা আমি পারব। তবু হাতে আইস অ্যাক্স টাও রাখা জরুরী
বুঝলে? একেবারে ক্লাইম্বিং এর ভঙ্গিমায়। ক্রিভাসের ওপারে ল্যান্ড করার সময় যদি
সেটা ভেঙে যায়, বা আমার পা পিছলে যায় তাহলে প্রাণপণে বরফে গেঁথে দেব এই বরফ কুঠার।
আরে বাবা, আধমরা হয়ে গেছি বলে কি ক্লাইম্বিং এর অ-আ-ক-খ ভুলে গেছি ভেবেছ?
কয়েক মুহুর্ত স্থির হয়ে
দাঁড়িয়ে থাকি আমি। আমার চারপাশের পৃথিবীও যেন শ্বাস রুদ্ধ করে প্রতীক্ষা করে সেই
মুহুর্তের। জীবন না মৃত্যু? পরের মুহুর্তে শরীরটাকে ছুঁড়ে দিই শূন্যে। সময় অনন্তে
পরিণত হয়। আমার মনে পড়ে ছোটবেলায় পেয়ারা চুরি করতে গিয়ে গাছের ডাল থেকে সরু
পাঁচিলে নিখুঁত লাফের দুপুর গুলো। সরু পিছল পেয়ারা গাছের ডাল, ঝুঁকে রয়েছে পুকুরের
পাড়ে; সেখান থেকে এক লাফে পাঁচিলের মাথায়। কত গ্রীষ্মের দুপুর যে কেটেছে শৈশবের
গেছোমি অধ্যায়ে তার শেষ কোথায়? কিন্তু লাফের শেষ হয়। কঠিন বরফের ওপর আমার শরীরটা
নেমে আসে পরিচিত ছন্দে। আচ্ছা, আমি কি চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম শেষ মুহুর্তে?
অসম্ভব! তাহলে হিমবাহ, ক্রিভাস এসব কোথায় ছিল এতক্ষণ? যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম
সেই নড়বড়ে ইটের পাঁচিল, সেই পানায় ঢাকা পুকুরের জল; আর পাচ্ছিলাম পেয়ারা পাতার
গন্ধ। সেগুলো কি মিথ্যে? আমি কি হ্যালুসিনেট করছিলাম?
হসপিটালে বসে ডাইরির পাতায় আমার পালিয়ে বাঁচার আঁকিবুঁকি |
˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜
৩ জীবন
কিন্তু এই মুহুর্তে, এই যে,
আমার সারা শরীরে বরফের কুচি, শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা, এবং ক্রিভাসের অন্য পাড়ে আমি;
এগুলো তো সবই সত্যি! কাশির দমক ওঠে। থামতে চায় না। মনে হয় কাশতে কাশতে বুকের পাঁজর
ভেঙে যাবে। এক অস্ফুট কণ্ঠস্বরে প্রলাপ বকে চলি আমি। নিজের গলা নিজেই চিনতে পারি
না। তবু সেই করাত ঘসা কাশির ফাঁকেই এক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি আমি। দুচোখ দিয়ে জল
গড়িয়ে পড়ে। চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। এটা কি আনন্দের কান্না? শরীরে এত কষ্ট, হিমবাহ পার
করতে আরও অন্তত চার দিন। বিপদ তো কাটেনি! তবু কিসের এই আনন্দ? এতো হতেই পারে
ক্ষণস্থায়ী! আসলে বুঝি, জীবন যে তখনই, সেই ক্রিভাসের গহ্বরেই শেষ হয়ে যায়নি সেটাই
যথেষ্ট এই চেতনার কাছে। প্রতি মুহুর্তের বেঁচে থাকা গুলোকে এক সূত্রে বেঁধে ফেলেই
তৈরি হয় একটা গোটা জীবন। সেই বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহুর্ত নিজেরাই নিজ গুনে
অমুল্য। বুঝতে পারি, সেই পুরনো কথাটা তাহলে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি! যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। সেই আশা একটা ছন্দ
যোগায়। চলার ছন্দ। পাথরের দেওয়ালটা বেয়ে এক পা এক পা করি উঠতে থাকি আর নিজেকে বলি,
আমি পেরেছি! ক্রিভাসটাকে এক লাফে আমি পার হয়ে এসেছি। যে শব্দ প্রথমে মৃত্যু সঙ্গীত
মনে হয়েছিল, সে ছিল প্রকৃতপক্ষে আমার মুক্তির স্তোত্র। মৃত্যুও তো একরকম মুক্তি।
তাই নয় কি?
˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜
Comments
Last line e gaan ta mone pore.. "oi moha sindhur opar hote ki songeet vese aase....!"