আপনি গাড্ডি সমঝো Apni gaddi samjho



রুইং একটা ছোট্ট তোলছা গ্রাম আকাশ ভেঙে বরফ বৃষ্টি হবার আশঙ্কা ছিল তাই গ্লেসিয়ারের ঠিকানা গুটিয়ে একটু তাড়াহুড়ো করেই নেমে এসেছিলাম মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় দুদ্দাড় করে দৌড়ে এক গাড়ি চলা রাস্তা ঘেঁষা গ্রামে! অথচ এই একই পথ উঠতে পাক্কা দুদিন লেগেছিল ভাবা যায়? প্রাণ নিয়ে পালানো বোধ হয় একেই বলে অবতরণ নয়, এ তো পতন! পঞ্চায়েত ঘরের ছাদের তলায় আস্তানা জুটেছিল ভিজে কাঠ অনেকটা ধোঁয়া ছেড়ে আগুনের আঁচ দিচ্ছিল। দুমুঠো চাল আর এক মুঠো ডাল তোবড়ান হাঁড়িটায় বসে গিয়েছিল। মেস টিনে মিষ্টি লাল চা দার্জিলিং মাস্কাটেল কে চোখ মটকাচ্ছিল। বিপদের আভাস পেয়ে বেঁচে ফিরে আসার মধ্যে এক অসাধারণ মৌতাত ছিল। তাতে ডুবে ছিলাম। বৃষ্টি, বরফ, ওয়েট স্নো অ্যাভালাঞ্চ আর ভাবাচ্ছিল না। 
বেস ক্যাম্প থেকে পাততাড়ি গুটনোর সকালে
তোলছারা ভোটিয়া, ঠিক মার্ছাদের মত দুজনে জাতভাই বলা চলে অলকনন্দা এবং ধৌলিগঙ্গা উপত্যকার একেবারে উপর দিকের, অর্থাৎ তিব্বত সীমান্ত ঘেঁষা লোকেরা মার্ছা আর একটু নিচের দিকের লোক হলেই তোলছা তবে দুজনেই সংসার গুটোয়, ফি বছরে অন্তত দুবার শীত পড়তে শুরু করলেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে, গরু ছাগল সমেত নিচের দিকের কোন গ্রাম তাদের ঠিকানা হয়ে যায় এই সমীকরণেই রুইং এবং তার প্রতিবেশী কাগা, দুনাগিরি, গরপকের শীতের ঠিকানা হয়ে যায় চামোলির কাছে মৈঠানা মাস উপত্যকার উষ্ণতায় কাটিয়ে আবার মে মাসের মাঝ বরাবর উচ্চতায় ফেরা আরম্ভ হয় এই গোটা সময়টা উপত্যকার দেখভাল অলিখিত ভাবে চলে যায় সেনা বাহিনীর হাতে তাদের বাড়ি ফেরার কিংবা বদলের উপায় নেই তারা রিমখিম, মালারি, নিতি, বাম্পা, গামসালি এইসব সুন্দর নামের নামের গ্রাম দূর থেকে অবসন্ন চোখে দেখতে থাকে, যদিও নজর থাকে চীন সীমান্তের দিকে  দেখা আর নজরদারির মধ্যে বিস্তর ফারাক যে! 
 
রুইং গ্রাম
যাই হোক, মে মাসের পাঁচ তারিখ বিকেলেও রুইং গ্রাম ছিল জনশূন্য। দিন সাতেক আগে, জোশিমঠ ছাড়ার সময়ই শুনেছিলাম আট-ন তারিখ থেকেই নাকি এক এক করে গ্রামের পরিবার ফেরা শুরু করবে। তাই রুইং তার পরিবারের প্রতীক্ষায় দিন গুনছিল। আর আমি গুনছিলাম প্রহর, গাড়ি ধরে বাড়ি ফিরে আসার। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই আবার ফিরতে হবে এই গাড়োয়াল হিমালয়ে। তাই যদি কয়েক দিন আগে বাড়ি ফেরা যায় তাহলে মন্দ কি? বাড়ি ছাড়ার সময় দুটো অভিযানের মাঝখানে বিশ্রাম হিসাবে বরাদ্দ ছিল মোটে ছদিন। কাজেই সেটা বেড়ে যদি হয় বারো তাহলে ডিল মন্দ হবে না। একেবারে যাকে বলে পোয়াবারো আর কি! পরদিন সাতসকালেই স্যাক ঘাড়ে তুলে হাঁটা। চল্লিশ মিনিটের মাথায় ধৌলির পুল পার করে বড় রাস্তায়।  কাছেই জুমার আর্মি ক্যাম্প থেকে স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার করে গাড়ির বন্দোবস্ত করব ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু, জওয়ান কাঁটাতারের ওপার থেকেই জানিয়ে দিল যন্ত্র বিকল। রোড পে খাড়ে হোকে চান্স লে লো আপ, উপদেশ ভেসে এল। মুড ভাল ছিল। তাই মুচকি হেসে জবাব দিলাম, আরে ভাই চান্স তো পুরা জিন্দেগি কে সাথ হি লে লিয়া, তো ডর কিস বাত কি? মালারি রোড পে হি রাত বিৎ যায়গা। হাসির উপাদান যথেষ্ট পরিমানে মজুত ছিল বাতাসে। সেই জওয়ান এবং এই ভবঘুরে, দুজনের জন্যই। ফুরফুরে মেজাজে তাই আর্মি ক্যাম্প ছেড়ে রাস্তায় নেমে এলাম।

ঘন্টাখানেকের মধ্যেই মালারির দিক থেকে গাড়ির শব্দ ভেসে এল। এইবার চান্সটাকে বাজিয়ে দেখবার সময় হয়েছে মনে করে উৎসুক হয়ে উঠলাম। বড় জোর ‘না’ বলবে এই তো, মনকে বোঝালাম। দূর থেকে দেখেই বোঝা গেছিল ওটা একটা ট্রাক। রঙ বলে দিয়েছিল ওটা ইন্ডিয়ান আর্মির। কাছে আসতেই হাত দেখালাম। এক প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে এবং অনেকটা লাল ধুলো উড়িয়ে ট্রাকটা থেমে গেল। ড্রাইভারের পাশের আসনে বসা ভদ্রলোক মধ্যবয়স্ক। ইউনিফর্মের আঁকিবুঁকি বলে দিচ্ছিল উনি অফিসার। ভাবলাম, অফিসার না হলে কি আর সামনে বসতে পেতো? জওয়ানদের স্থান তো শান্তির সময় পশ্চাতে, প্রবল ঝাঁকুনি এবং ধুলোর সহাবস্থানে। যুদ্ধের সময় আগে বাড়ো, সিনে পে গোলি খাও। অফিসার সিঙ্গল মল্ট আর তুমি কন্টেসা রাম। ভারতীয় সেনার এই ‘অফিসার-শাহী’-র ব্যাপারটা একাধিক ফৌজি বন্ধুর সুবাদে জানা ছিল। আক্ষরিক অর্থেই ‘কোণঠাসা রাম’ যাকে বলে। তবে দুয়েকজন সাহসী অফিসার যে নেই তাও নয়। তা না হলে তো কবেই সিস্টেম গড়বড় হয়ে যেত! সিভিলিয়ান হো কেয়া? ইয়াহাঁ পে কেয়া কর রহে হো? আকেলা হো? অনেকগুলো প্রশ্নে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল। যথাযথ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলাম। চোখের নজরে সম্মতি দেখতে পেলাম। অফিসার বললেন, চড় যাও পিছে। আমি দড়াম করে একটা স্যালুট ঠুকে ঝুলে পড়লাম ট্রাকের পশ্চাতে। সঙ্গে সঙ্গে দুজোড়া মজবুত হাত এগিয়ে এল আমার সাহায্যে। আমি এবং আমার ঝোলা দুজনেই মুহুর্তে ঢুকে পড়লাম ট্রাকের পেটে। দেখলাম দশ জোড়া সহাস্য চোখ আমার ওপর নিবদ্ধ। এক কোন থেকে একজন বললেন, বয়ঠ যাও জী কহিঁ ভি। আপনি গাড্ডি সমঝো। বলতেই এক হাসির রোল উঠল। ধৌলি গঙ্গার গর্জন সেই হাসির কাছে ফিকে হয়ে গেল। 
                  
আমিও হাসলাম। আমার দেশ, আমার মানুষ। আমার ভারত। কিছু লোক ‘মাতা’ কি জয় আর ‘পিতা’ কি জয় নিয়ে তর্ক বাঁধাবে। আপনার ভয় কোথায়? আসলে তো ‘আপনি গাড্ডি’বসে পড়ুন যেখানে খুশি।  

ধৌলি গঙ্গা উপত্যকা
     

Comments

Popular posts from this blog

Across The Sahara on a Bicycle

To the Mountains of the Moon: A Journey from Fiction to Facts

Straight from a Story Book: Part I