লোকটিকে কেউ বলতেন অরণ্যদেব। আবার কেউ বলতেন হ্যাট পরলেই অবিকল গ্রেগরি পেক। আজ মনে হয়, এসবই
ছিল এক অসম্ভব মজবুত গড়নের সুগঠিত মানুষকে বর্ননা দেবার একটা ঢিলেঢালা প্রয়াস। এই নামকরণ ছিল আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের মতই ঢিলেঢালা, গা-ছাড়া, ক্যাসুয়াল, সুপারফিশিয়াল, আন্তরিক নয়। নামকরণের উদাহরণ গুলোও বেশ লক্ষ্য করার মত। একজন ফ্যান্টাসি কমিক বুক চরিত্র ‘অরণ্যদেব’ এবং অন্যজন হলিউডের তারকা ‘গ্রেগরি পেক’। এক কথায় দুজনই নাগালের বাইরে। তাদের সঙ্গে তুলনা করা হল এক বঙ্গসন্তানের। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এমনটা কেন হল?
আসলে আমাদের মত অ্যাভারেজ হাইট বাঙালির ভিড়ে একটু পৃথক যারাই হয় তাদের চট করে একটা তকমা পরিয়ে দেওয়া হয়। এই অভ্যাস নতুন নয়। নামকরণে সিদ্ধহস্ত আমরা। নামকরণ, পূজা প্রকরণ, নৈবেদ্য, চার ফোঁটা গঙ্গার জল, ঘেঁটু পূজা, সত্যনারায়ণের সিন্নি এবং মাঝেমধ্যেই রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দ-মার্ক্সের দোহাই। এই তো আমাদের বিস্তার! সেই বাঙালির পর্বতারোহণ ঠিক যেন তাই সোনার পাথর বাটি। ক্লাবের ছাতা ধরে ফি বছর অভিযানে যাব, শেরপাদের বেঁধে দেওয়া দড়ি ধরে চুড়ায় উঠে পড়ব, পাড়ায় ফিরে কলার তুলব- এই ‘ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে’। ঠিক যেন বাৎসরিক শ্রাদ্ধ। নট বাধা শিখব না, ম্যাপ পড়া শিখব না, শিখব না একটা বিলে স্টেশন তৈরি করা, শিখব না ট্র্যাড লিড করা, শিখব না নতুন কিছুই। তাই, স্বাভাবিক ভাবেই, এনাদের পুরুলিয়ায় টপ রোপ আর হিমালয়ে ফিক্সড রোপ ছাড়া ক্লাইম্ব করার মুরোদ নেই এবং ইচ্ছা নেই নিজেদের চেষ্টায় ছোটখাট কোন একটা শৃঙ্গে আরোহণের। অথচ এরকমটা হোক আমাদের সেই ‘অরণ্যদেব’ কিংবা ‘গ্রেগরি পেক’ চান নি। তাই শেখাতে চেয়েছিলেন মনপ্রান উজাড় করে।
আসলে আমাদের মত অ্যাভারেজ হাইট বাঙালির ভিড়ে একটু পৃথক যারাই হয় তাদের চট করে একটা তকমা পরিয়ে দেওয়া হয়। এই অভ্যাস নতুন নয়। নামকরণে সিদ্ধহস্ত আমরা। নামকরণ, পূজা প্রকরণ, নৈবেদ্য, চার ফোঁটা গঙ্গার জল, ঘেঁটু পূজা, সত্যনারায়ণের সিন্নি এবং মাঝেমধ্যেই রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দ-মার্ক্সের দোহাই। এই তো আমাদের বিস্তার! সেই বাঙালির পর্বতারোহণ ঠিক যেন তাই সোনার পাথর বাটি। ক্লাবের ছাতা ধরে ফি বছর অভিযানে যাব, শেরপাদের বেঁধে দেওয়া দড়ি ধরে চুড়ায় উঠে পড়ব, পাড়ায় ফিরে কলার তুলব- এই ‘ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে’। ঠিক যেন বাৎসরিক শ্রাদ্ধ। নট বাধা শিখব না, ম্যাপ পড়া শিখব না, শিখব না একটা বিলে স্টেশন তৈরি করা, শিখব না ট্র্যাড লিড করা, শিখব না নতুন কিছুই। তাই, স্বাভাবিক ভাবেই, এনাদের পুরুলিয়ায় টপ রোপ আর হিমালয়ে ফিক্সড রোপ ছাড়া ক্লাইম্ব করার মুরোদ নেই এবং ইচ্ছা নেই নিজেদের চেষ্টায় ছোটখাট কোন একটা শৃঙ্গে আরোহণের। অথচ এরকমটা হোক আমাদের সেই ‘অরণ্যদেব’ কিংবা ‘গ্রেগরি পেক’ চান নি। তাই শেখাতে চেয়েছিলেন মনপ্রান উজাড় করে।
কিন্তু, মানুষটির প্রানের কথায়, মনের ভাষায় আগ্রহ আমাদের কোনদিনই
ছিল না একটুও। আগ্রহ বিহীন উল্লাসের প্রাচীন এই অভ্যাস পরিস্থিতির পরিবর্তনেও বদলায় কোথায়? পুনরাবৃত্তির বহু আবর্তিত বৃত্ত ক্রমশ আরও সঙ্কির্ন, আরও সংকুচিত হতে থাকে। অদৃশ্য হয় না। আর কদাচিৎ, কখনও একরকম হঠাৎ করেই সেই বৃত্তের একটা কেন্দ্র খুঁজে পাওয়া যায়। আজকের সেই বৃত্তের কেন্দ্র বিন্দুটির নাম অমিয় মুখোপাধ্যায়। পর্বতারোহী, রক ক্লাইম্বার এবং লেখক অমিয় মুখোপাধ্যায়। মাস খানেক আগে তিনি চলে গেছেন আমাদের দেওয়া ‘অরন্যদেব’ কিংবা ‘গ্রেগরি পেক’ এর মুখোশ কিংবা মলাটের পরোয়া না করে। যেমন করে অনেকেই যান। অন্যমনস্কে চলে যান বিষাদের বিশেষ অবসর না রেখে। চলে যান বিস্মৃতির কোনও অচেনা পাড়ায়। তবু মনে হয় জীবনের শেষ বেশ কিছু বছর নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। সরিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর পরিচিত, স্বচ্ছন্দ বিচরণ ক্ষেত্র থেকে। পশ্চিম বাংলার পাহাড়ি ক্লাব এবং তাদের কর্মকাণ্ড তাঁকে আর বিশেষ আকর্ষণ করছিল না। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি কোন অভিমানের ছায়া ছিল তাঁর মনে?
জীবনের একটা বড় অংশ প্রথমে পর্বতারোহণ এবং পরে রক ক্লাইম্বিং প্রশিক্ষণে ঢেলে দেবার পর হঠাৎ অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন অমিয়। যোগাযোগ রেখেছিলেন কেবল হাতে গোনা কিছু ছাত্র-বন্ধুর সঙ্গে। মাঝে মধ্যে, সেই সব অন্তরঙ্গ অবসরে, নিভৃত আলাপচারিতায় যা উঠে আসত, তা কিন্তু বিষাদ নয়, বরং বলা যেতে পারে কিছুটা ক্লান্ত অভিমান। অভিমান এবং বিষাদের আক্ষরিক অর্থের গুণগত পার্থক্য বিচার না করে বরং দেখা যাক অমিয় কে ছিলেন। ১৯৫৯এ গাংনানি থেকে হেঁটে গোমুখ যান অমিয়। হিমালয়ের সঙ্গে
সেই প্রথম পরিচয়। ১৯৬৬ তে ‘যুগল মানা’ অভিযানে হয় পর্বতারোহণে হাতেখড়ি। ১৯৬৭ এবং
’৬৮ তে দার্জিলিং এর হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট থেকে নেন পর্বতারোহণে
বেসিক এবং অ্যাডভানস ট্রেনিং। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৯, দশ বছরের মধ্যে অমিয় ১৪ টি অভিযানে অংশ নেন এবং ১১টি শিখর আরোহণ করেন। এই অভিযান গুলির বিস্তারেই জন্ম নেয় শেরপা বিহীন শিখর আরোহণের প্রচেষ্টা। আজ যখন দেখতে পাই তাঁর সেই সব প্রচেষ্টা ছড়িয়ে ছিল সতোপন্থ কিংবা কামেট এর মত দূর্গম শৃঙ্গ থেকে অনামা অজানা শৃঙ্গে; তখন কুর্নিস জানাতে ইচ্ছে হয় বৈকি! রক ক্লাইম্বিং প্রশিক্ষক হিসাবেও তাঁর পরিচিতি কোনও অংশে কম নয়। দার্জিলিং থেকে শেরপা ইনস্ট্রাক্টর এনে শুশুনিয়ায় রক ক্লাইম্বিং শিবির করার ঘরানা মূলত অমিয় এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন পাহাড়িয়ার হাত ধরেই বন্ধ হয়েছিল। রক ক্লাইম্বিং এর পাশাপাশি তাঁর প্রিয় ছাত্রদের কমান্ডো এবং সারভাইভাল ট্রেনিং দিতেন অন্তরঙ্গ নিষ্ঠায়। অমিয়ের কাছে রক ক্লাইম্বিং এবং সারভাইভাল কোর্স করার সৌভাগ্য যাদের হয়েছিল তারা
আজও স্মৃতি রোমন্থন করেন এক দুর্দান্ত অ্যাডভেঞ্চারের। এই স্মৃতি আসলে সাক্ষী বাংলার
পর্বতারোহন এবং রক ক্লাইম্বিং এর এক ঝলমলে, প্রতিশ্রুতিময় অধ্যায়ের।
a perfectionist on rock |
পশ্চিম বাংলার পর্বতারোহন তথা শৈলারোহণের পটভূমিকায় সেই অধ্যায় ছিল বসন্ত আসার ইঙ্গিত যা পরবর্তী কালে বিদ্যুৎ সরকার এবং গৌতম দত্তের হাত ধরে কিছুটা সাবালক হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কিন্তু, তারপর কোথায় যেন খেই হারিয়ে
যায়। পরিশ্রমসাধ্য প্রশিক্ষণের হাত ধরে উত্তরনের পথ ছেড়ে আজ সবেতেই দেখা যায় শর্টকাটের
খোঁজ। ‘ফ্রিডম অফ দি হিলস’ এর জন্য নয়, আজ পাহাড়ে যাওয়া হয় রাতারাতি সেলিব্রিটি হবার
জন্য। মাউন্ট এভারেস্ট সহ বেশ কিছু আট হাজারি শৃঙ্গে তো আজ হাইওয়ে বানিয়ে ফেলেছে
নেপালি এজেন্সিরা। বাঙালির আট হাজার মিটারের শৃঙ্গে আরোহণের স্বপ্ন যে এই পরিণতি
পাবে তা নিশ্চয়ই স্বপ্নেও ভাবেননি এক সময়ের স্বপ্ন গড়ার কারিগরেরা। অমিয়কেও দেখে যেতে হয়েছে এই দুঃসময়। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। তাই ফিরে আসা যাক এই আলোচনা বৃত্তের কেন্দ্র- অরণ্যদেব, গ্রেগরি
পেক, কিংবা অমিয় মুখোপাধ্যায়-এ।
A dedicated rock climbing instructor |
আজ বলতে দ্বিধা নেই, কেবল গাল ভরা নামকরণই করেছি আমরা তাঁর। কি বলতে চেয়েছিলেন মন দিয়ে শুনিনি একবারও। কেবল লেজেন্ড তৈরি করেছি, লেগেসির কথা ভাবিনি। অবশ্য কথা বলার চেয়ে কাজে করে দেখানটাই তাঁর কাছে সবসময় অধিক প্রিয় ছিল। বলিয়ে কইয়ে বলে নাম-ডাক মোটেই ছিল না তাঁর। বরং বুড়ো আঙুলের এক মৃদু চাপে কোমরের বো-লাইন নট-কে আরও নিরাপদ করে তুলতে বেশি পছন্দ করতেন। মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোনের সামনে হাসি মুখে দাঁড়ানোর থেকে কোন রক ফেসের গায়ে ঘর্মাক্ত শরীরে অগনিত বার ওঠানামা করিয়ে প্রিয় ছাত্রকে গড়ে তোলার কাজটাই ছিল তাঁর মনের মত। তাই বিদায় অমিয় মুখোপাধ্যায়। জীবিত থাকতেই যাকে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দিয়েছিলাম আমরা, আজ আবার তাঁকে নিয়েই লেখা ছাপার আগ্রহ এক চরম পরিহাস ছাড়া কিছুই মনে হয় না। কফিনে শেষ পেরেক হয়ত এভাবেই মারা
হয়।
Sujal Mukherjee (left) and Amiya Mukherjee (right) on the summit of an unnamed peak during their Raktavarn Glacier Expedition in 1977 |
5 comments:
Amazing
Thanks. Please share. regards
A brave soul of this city. Hats off to him for his contribution for imparting training to the youths.
Knew him as an affectionate personality with great heart... dedicated for the development of our youngsters. Feel myself fortunate as he loved me as well. He used to visit Barasat(where I reside), to attend one of his close relationship very often, creating chance for me to meet him at times. His demise, undoubtedly,is a great loss for the Adventure field of our state. Do convey my deep gratitude to him and pray for his soul to rest in peace wherever it be!������-Gautam Dutta
Knew him as an affectionate personality with great heart... dedicated for the development of our youngsters. Feel myself fortunate as he loved me as well. He used to visit Barasat(where I reside), to attend one of his close relationship very often, creating chance for me to meet him at times. His demise, undoubtedly,is a great loss for the Adventure field of our state. Do convey my deep gratitude to him and pray for his soul to rest in peace wherever it be!🙏🙏🙏-Gautam Dutta
Post a Comment