Sunday, August 28, 2022

চ্যাটারটন মারা গেছেন, চ্যাটারটন আবার মারা যাবেন

দি ডেথ অফ চ্যাটারটন, ১৮৫৬, হেনরি ওয়ালিস 


সারাদিন ধরে আমার ঘরের দেওয়াল, জানলার পাল্লা, 
পায়া-ভাঙা চেয়ার, স্তূপাকৃতি ধুলো-ঢাকা প্রাচীন আসবাব-
সব কিছু দেখি আমি। 

সত্যি, আমাদের সব কিছু পুরোনো, ধুলোপড়া, ভাঙাচোরা। 
তবু একটা ক্লান্ত, মলিন লাবণ্য যেন রয়েছে কোথাও। 
ঠাম্মার আদরের মত,
লেপ্টে রয়েছে সবকিছুর গায়ে।  

একদিন এই ঘরে বাবা-মা থাকত। 

এখন এই ঘরে আমি থাকি। 

আমি চলে যাবার পর হয়ত অন্য কেউ থাকবে। 

তার চোখে এই লাবণ্য দেখা দেবে কী? মলিন হয়েও দেখা দেবে কী? 

অবশ্য, না দিলেই বা কী আসে যায়! 

চ্যাটারটন মারা গেছেন, চ্যাটারটন আবার মারা যাবেন।  


Tuesday, August 23, 2022

'বাংলার পর্বতারোহণের ঘোলা জলে মাছ ধরা কী যার তার কর্ম?'

গত ২০ আগস্ট, ২০২২, ড্রিম ওয়ান্ডেরলুস্ট এবং 'কলকাতা প্রকৃতি পরিব্রাজক সমিতি'র সদস্যগণ- যৌথ উদ্যোগে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলেন। আলোচনার বিষয় ছিল- 'কোন পথে বাংলার পর্বতারোহণ'।  বিষয় শিরোনামের শেষে জিজ্ঞাসার চিহ্ন, কিংবা বিস্ময় সূচক চিহ্ন- দুটোর কোনটাই না থাকায়  একটা ব্যাপার আঁচ করে নেওয়া যেতে পারে এবং সেটা হল আয়োজকদের মনে পশ্চিমবাংলার পর্বতারোহণের গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে একটা সংশয় থাকলেও ( সংশয় নিশ্চয়ই ছিল, তা না হলে খামোখা এরকম একটা সভা ডাকতে যাবেন কেন?), তাঁরা সেটা সদর দরজায় লিখে দিতে চাননি। মানে, একটা মাছ ধরার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু নিজেরা জলে নামতে ( কিংবা ছিপ ফেলতে) তাঁরা রাজী ছিলেন না। সে দ্বায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই ছিল নির্বাচিত বক্তাদের ঘাড়ে। 

নিজেরা চিহ্নিত মাউন্টেনিয়ার না হয়েও, এরকম একটা দুঃসাহসিক উদ্যোগের জন্য আয়োজকদের আমি সাধুবাদ জানাই। একটা কথা স্পষ্ট- আয়োজকদের এই কৌতূহল ( মানে, 'কোন পথে যাচ্ছে ব্যাপারটা'? গোল্লায়? না, কেবলই পারস্পরিক তোল্লায়?) প্রসূত হয়েছে তাঁদের হিমালয় এবং পর্বতারোহণের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা থেকে। কিন্তু একথা ভুললে চলবে না- বাংলার পর্বতারোহণের জলটি ঘোলা এবং সেই ঘোলা জলে মাছ ধরা কী যার তার কর্ম?  বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘোলা জলে পুঁটি কিংবা রুই - এই জাতের মাছই ধরা পড়ে বেশী। কিন্তু বাংলার পর্বতারোহনের ঘোলা জলে যে রাঘব বোয়ালরা ( এবং কিছু মবি-dick, কিংবা মন্টি পাইথনে উল্লিখিত ' Biggus Dickus'  ) চিরকাল দাপিয়ে বেড়ান- তাঁদের ধরা কোনও ক্যাপ্টেন আহাব রূপী আলোচনা সভারই সাধ্য নয়। 

ঘটনাচক্রে, সেই সভায় আমন্ত্রিত বক্তাদের তালিকায় আমার নামও ছিল। ভাবুন কাণ্ড! প্রাথমিক ভাবে, ২০ তারিখ দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর যেহেতু আমার আর কোন কাজ ছিল না তাই ব্যক্তব্য রাখতে রাজী হয়ে গেছিলাম । আমার বিচিত্র কৌতুকবোধকে মাফ করবেন। আসলে আমি বক্তব্য রাখতে রাজী হয়েছিলাম একটাই কারণে-for posterity। 

যে সম্প্রদায় তাঁদের সমস্যাটা কী, সেটা বুঝেও বুঝতে চান না- তাঁরা ভাবের ঘরে চুরি করে থাকেন এবং তাঁদের গুড়ে পুরোটাই বালি। তবুও, আয়োজকদের সম্মানার্থে আমি  খুব সিরিয়াসলি ১৪ মিনিটের একটা 'আর্গুমেন্ট'-ও পেশ করেছিলাম- করেছিলাম পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভেবে।  

মনে রাখবেন একটা ১৪ মিনিটের টকে বিষয়বস্তুর চুল চেরা বিশ্লেষণ সম্ভব হয়নি ( আমার দ্বারা হয়নি), তাই খানিক সরলীকরণ থেকেই গেছে। এ বিষয়ে একটা গোটা বই লিখে ফেলা সম্ভব, কিন্তু সে ইচ্ছা আমার মোটেই নেই। তবে আঁতে ঘা যাঁদের লাগার ( জুমারিস্ট, ক্লাবের পেট মোটা কর্মকর্তা, এভারেস্টের সোনার টুকরো ছেলে/মেয়ে) তাঁদের লাগবে। সেটাই উদ্দেশ্য ছিল।  পাণ্ডিত্য ভাল, তবে ক্লাইম্বিং ক্রাফটটা আগে শেখার মত করে শিখুন, একটু একটু করে নিজেদের উন্নত করুন, তারপর নিজের দমে ক্লাইম্ব করুন। এটুকুই বলতে চেয়েছি দাদাগো।  

টুরিস্ট এবং ক্লাইম্বার- একই বৃন্তে দুইটি কুসুম কখনই নয়। হাতি যে কারণে অ্যাসপিরিন নয়- সেই কারণেই নয়। সেটাই এই টকের মোদ্দা কথা।



ঘনিষ্ঠ দুয়েকজনের অনুরোধে আমার সেদিনের বক্তব্য  এই ব্লগে দিলাম। আমার 'আর্গুমেন্ট' কিছু স্লাইড সহযোগে ছিল। সেই স্লাইডগুলি কখনও রূপকার্থে, কখনও আক্ষরিক অর্থে রাখা হয়েছিল। লেখার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সেই স্লাইডগুলিও এখানে দিলাম। প্লেজিয়ারিজমের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে জেনেও দিলাম।  


(প্রথম কয়েকটা লাইন ছিল আমার সেদিনের পূর্ব-কথন। তারপর, ১, ২ করে স্লাইড অনুসারে ব্যক্তব্য।)  

কোন পথে বাংলার পর্বতারোহণ   -অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায় 

Arguably, এই পশ্চিমবাংলায় পর্বতারোহণের জন্ম পঞ্চাশের দশকে, এই পশ্চিমবাংলা থেকে ষাটের দশকেই All Female Mountaineering Expedition হয়েছিল। তারপর পুরোদস্তুর একটা all-female mountaineering club ও ছিল। এখনও বাংলার মেয়েরা mountaineering করে। তাই আমার মনে হয় আজকের বক্তাদের মধ্যে অন্তঃত ৫০ শতাংশ মহিলা থাকা উচিৎ ছিল। কিন্তু আজ বক্তাদের মধ্যে একজনও মহিলা পর্বতারোহী নেই। কেন নেই, সেটা নিয়ে ভাবা দরকার, নিজেদেরকে প্রশ্ন করা দরকার বলে আমার মনে হয়। কিন্তু আজ যেহেতু সময় সীমিত- তাই আমাকে নিজের ব্যক্তব্য শুরু করতে হচ্ছে।     


১- দাম্ভিক আত্মপ্রচার মনে হতে পারে, কিন্তু খানিকটা বাধ্য হয়েই নিজের ঢাক পেটানো দিয়ে আরম্ভ করছি। তার কারণ, এখানে উপস্থিত অধিকাংশ মানুষই আমার কাজ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেন না। জানার কথাও না, কারণ আমি স্বনামধন্য কেউ নই এবং বাংলার পর্বতারোহণের পটভূমিকায় নিজেকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ লোক বলে আমি মনে করি না। তবে আজকের আলোচনা সভায় যেহেতু আমি একজন আমন্ত্রিত বক্তা- তাই হযবরল-র শ্রী ব্যাকরণ শিং (বি. . খাদ্যবিশারদ)-এর মত বলতে ইচ্ছে করছে- উপস্থিত বালকবৃন্দ স্নেহের হিজিবিজ্বিজ্‌, আজ অনেক বছর বাদে তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে বড় ভালো লাগছে এই বছর উৎকৃষ্ট খাদ্য গবেষণার কারণে প্রবাসী হতে হয়েছিল আবার ফিরে এসেছি


- জোকস অ্যাপার্ট- আজ থেকে ২১ বছর আগে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম হিমালয়কেই নিজের জীবন করে নেব বলে। ব্যাপারটা খুব ইউটোপিক শোনাচ্ছে তো? কিন্তু এটাই ঘটেছিল। হিমালয় নিয়ে কী করে জীবন কাটাবো? আমার তো বাপের জমিদারি নেই? নায়েব মশাই খাজনা তুলে আনেন না। তবু একদিন সেই ঝাঁপ দিয়েছিলাম। আসলে হিমালয়ের টান এত ভয়ংকর ছিল যে ঝাঁপ না দিয়ে পারিনি। আর্থিক নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্ক সেই যে শেষ হয়েছিল- আজও তা ঠিক হয়নিকাজ শুরু করেছিলাম ট্রেকিং গাইডের মত করে- দল নিয়ে সন্দকফু-কেদারতাল- এইরকম আর কি! সেদিন এই কলকাতারই কিছু লোকজনকে বলতে শুনেছিলাম- ‘সুজলদার ভাইপো পাহাড় ভালবাসে না- পাহাড় নিয়ে ব্যবসা করে’ তবে আজ বলতে দ্বিধা নেই, গত বিশ বছরের জীবনে কবির ভাষায়- “যা দেখেছি যা পেয়েছি/ তুলনা তার নাই ভাগ্যিস ঝাঁপ দিয়েছিলাম!



-যেহেতু আজকের বিষয় পর্বতারোহণ কেন্দ্রিক- তাই সাইক্লিং, ব্যাকপ্যাকিং এবং আমার অন্যান্য অ্যাডভেঞ্চারের কথা আজ তুলছি না। গত ২১ বছরে, ভারতীয় হিমালয়ে আমি ৬০টি মাউন্টেনিয়ারিং এক্সপিডিসনে অংশ নিয়েছি- তার ৯০ শতাংশই আমার নিজের planned- organised এবং আমি নিজে সবকটিতে ক্লাইম্বিং লিড করেছি এবং গাইডের কাজ করেছিএগুলো সবই ছিল বিদেশী অভিযান এবং দলের সদস্যরা টুরিস্ট নয়- ক্লাইম্বার বিদেশীদের ক্লাইম্বিং গাইডের কাজ করতে গেলে ক্লাইম্বিংটা সত্যি সত্যি জানতে হয়, সাইড লাইনে বসে বক্তৃতা দিয়ে পার পাওয়া যায় না, শারীরিক সক্ষমতার কথা নাহয় বাদই দিলাম। ক্লাইম্বিং অভিযানের পাশাপাশি আমি অগণিত ট্রেকও লিড করেছি এবং দীর্ঘ ৫ বছর আমি ডগ স্কটের ট্রেক দলগুলির গাইড হিসাবে কাজ করেছি। হ্যাঁ-ঠিকই শুনছেন- ডগ স্কট। উনি আমাকে খুবই স্নেহ এবং ভরসা করতেন।   



৪- হিমালয়ে বেশ কিছু নামকরা পিকে গেলেও বরাবরই আমার আগ্রহ এক্সপ্লোরেটরি অভিযানে বেশী হিমালয়ের বাইরে আমি গ্রিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, সুইস এবং ফ্রেঞ্চ আল্পস, উত্তর আমেরিকায় সিয়েরা ক্যাসকেড, কিরগিজস্তান এবং পেরুতে ক্লাইম্ব করেছি। এলব্রুসে স্পিড ক্লাইম্বিং প্রতিযোগিতায় খারাপ ফল করিনি। কেনিয়ায় বিগ ওয়াল ক্লাইম্ব করেছি। কখনও সামিট হয়েছে- কখনও হয়নি তবে বড় মুখ করে এইসব বলার কারণ কী জানেন? এগুলোর কোনটাই কোন ট্রাভেল এজেন্সির প্যাকেজ ছিলনা। সব ক্লাইম্বই ছিল নিজের দমে করা।



৫- হ্যাঁ, নিজের ঢাক পেটানো দিয়ে আমি একটা কথাই বলতে চাইছি- এবং তা হল, আজকের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে এই বক্তার একটা সম্যক ধারণা রয়েছে। দু-দশকের কাজের মধ্য দিয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি, গ্রো করেছি এবং একটা ধারণা অর্জন করেছি। ব্যক্তব্যের গোড়াতেই শ্রোতাকে এটুকু জানিয়ে রাখা আমার জরুরী মনে হল। এবার আজকের প্রসঙ্গে আসি।



৬- পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে, ইওরোপ-আমেরিকার পাহাড়িয়াদের আড্ডায়, একটা সম্ভাবনার কথা শোনা যেত শোনা যেত, হিমালয় এবং কারাকোরামের উচ্চতম সবক’টি পাহাড় ক্লাইম্ব হয়ে গেলেই নাকি, পর্বতারোহণের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হবে তখন আর হাল্লা-চলেছে-যুদ্ধের কায়দায় বিশাল আকার-প্রকারের অভিযান সংগঠিত হবে না তখন কেবল গুটিকয় বন্ধু, অপেক্ষাকৃত ছোট পাহাড়ে, কঠিনতর ক্লাইম্বিং চ্যালেঞ্জের সন্ধানে পাড়ি দেবে। নিজেদের দেশের পাথর-বরফে ঘষা খেয়ে প্রতিনিয়ত উদ্ভাবিত হয়ে চলা নতুন ক্লাইম্বিং পদ্ধতি, শৈলী এবং সরঞ্জামের যথার্থ প্রয়োগের ক্যানভাস খুঁজে বেড়াবে এই নতুন প্রজন্মের পর্বতারোহীরা- হিমালয় এবং কারাকোরাম জুড়েবলা হত, আফটার অল, ক্লাইম্বিং ইস অলসো আ ফর্ম অফ আর্ট এবং আর পাঁচটা আর্ট ফর্মের মতোই পর্বতারোহণও বিবর্তিত, উন্নত, আধুনিক হবে এবং মানুষকে ভাবতে বাধ্য করবে



- ১৯৫৬ সালে, মুজতাঘ টাওয়ারে ব্রিটিশ অভিযানের সাফল্য দেখিয়ে দিয়েছিল কারাকোরাম বা হিমালয়ের মতো প্রত্যন্ত পর্বতমালায়, ৭০০০ মিটারের শৃঙ্গে, কলোনিয়াল ঘরানার বাহুল্য বর্জন করেও অতি উচ্চ মানের টেকনিকাল ক্লাইম্বিং কী ভাবে করা যায় ট্রেভর ব্রাহাম লিখেছিলেন, “১৯৭০ সালের অন্নপূর্ণা সাউথ ফেস ক্লাইম্বের থেকেও, সময় এবং পরিস্থিতির বিচারে ১৯৫৬ সালের এই ক্লাইম্ব প্রকৃত অর্থেই পথপ্রদর্শক ছিল” তার ঠিক পরের বছরই আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল ব্রড পিকে। অস্ট্রিয়ার এই দলে ছিলেন মাত্র চারজন ক্লাইম্বার। কোনও শেরপা, হাই-অল্টিচিউড পোর্টার ইত্যাদি ছাড়াই ব্রড পিক ক্লাইম্ব করেই তাঁরা থেমে থাকেননিদল এবার দু’ভাগে ভাগ করে নিয়ে তাঁরা দু’টি ভিন্ন শৃঙ্গে আরোহণ শুরু করেছিলেন। দু’জন গেছিলেন ৭৪২০ মিটারের এক অনামা শৃঙ্গে, আর অন্য দু’জন চেষ্টা করেছিলেন চোগোলিসা (৭৬৫৪ মিটার) ক্লাইম্ব করারএই দ্বিতীয় দলে ছিলেন হারমান বুল এবং কুর্ট ডিয়েমবার্গার। দুর্ভাগ্যক্রমে এই চোগোলিসাই ছিল প্রবাদপ্রতিম হারমান বুলের শেষ ক্লাইম্ব। কিন্তু, সামিট রিজের কর্নিস ভেঙে বুলের মতো পর্বতারোহীর মৃত্যুর পাশাপাশি যে-স্বপ্নটা বিশ্বের পর্বতারোহীদের মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল, তা হল— কয়েকজন বন্ধু মিলে হিমালয়-কারাকোরামের মতো বৃহত্তর পর্বতমালায় গিয়ে তাহলে কেবল একাধিক টেকনিকাল পিকই নয়, আট হাজারি শৃঙ্গও ক্লাইম্ব করা সম্ভব।



৮- এই চালচিত্র থেকে জাম্প-কাট করে যদি চলে আসি ১৯৮১ সালে, নন্দাদেবী স্যাংচুয়ারির দক্ষিণ দেওয়ালে, তাহলে দেখতে পাব বিদ্যুৎ সরকারের নেতৃত্বে মাইকতোলি সহ মোট তিনটি বাইশ হাজার ফুটের শিখর আরোহণ করছেন গৌতম দত্ত এবং অমূল্য রায়। করছেন কোনও শেরপা কিংবা হাই-অল্টিচিউড পোর্টারের সাহায্য ছাড়াই। দেখতে পাব, রামধনুর দুই প্রান্তের মতোই কারাকোরামে হারমান বুলের জন্ম দেওয়া স্বপ্নের ক্লাইম্বিং ঘরানা এবং দর্শন মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছিল বাংলার এই ক্লাইম্বারদের আইস-অ্যাক্সে ভর করে।



৯-ষাটের দশকের শেষ দিকে এই সম্ভাবনার রশ্মি আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গেও এসে পৌঁছেছিল। ক্লাইম্বিং জগতের হাঁড়ির খবর বাংলার কিছু ক্লাইম্বার তখনই রাখতেন। সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশক জুড়ে বাংলায় এসেছিল হিমালয়ের ক্যানভাসে অ্যাল্পাইন স্টাইলে পর্বত আরোহণের আর্ট এবং শেরপাদের কাঁধে ভর না করে নিজেদের ক্ষমতায় শিখর আরোহণের প্রচেষ্টা। শিপটন-টিলম্যানের মতো, আটা ভাজা, ছাতু আর পাটালিগুড়ে হিমালয় ডিঙোনোর শক্তি, ’৭০-’৮০র দশকের একঝাঁক বাঙালি ক্লাইম্বাররাও আপন করে নিয়েছিলেন।



১০-অথচ আজ, এই ২০২২-এ দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতেই হয় যে, পর্বতারোহণের আধুনিক ধারায় পা রেখে নতুন অধ্যায়ের সূচনা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি- -বরং তৈরি হয়েছে একটা কনফিউশন।  কারণ হল, বিগত দুই দশকে জমিতে বেনো জল ঢুকেছে বাঁধভাঙা বন্যার মতোফলে, নবাগতের পদার্পণ এবং যথাসময়ে উত্তরণের মুখ্য দার্শনিক শর্ত এবং তার উদ্দেশ্যের বিশুদ্ধতা- বিষিয়ে গেছে। হিলারি, মেসনার থেকে স্টিফেন ভেনাবলস— এঁরা সকলেই সহমত এই একটা ব্যাপারে। লেট মি এক্সপ্লেন।  



১১- নব্বইয়ের দশক থেকে সেই যে মাউন্ট এভারেস্টের গায়ে ‘ফর সেল’ তকমা লেগেছিল আজ তা এক মহামারীর রূপ নিয়েছে। প্রথমে বাছা বাছা কিছু পাহাড়কে (যেমন কিলিমানজারো, ম্যাটারহর্ন, আকোঙ্কাগুয়া, এলব্রুস এবং মাউন্ট এভারেস্ট) ব্র্যান্ডিং করা হয়েছিল এবং তাদের পণ্য করে ইওরোপ এবং আমেরিকায় একের পর জন্ম নিয়েছিল অ্যাডভেঞ্চার বেচার কোম্পানি— অ্যাডভেঞ্চার কনসালট্যান্টস, মাউন্টেন ম্যাডনেস, জ্যাগেড গ্লোব ইত্যাদি তারপর, কয়েক বছর যেতে না যেতেই জন্ম নিয়েছিল অপেক্ষাকৃত সস্তা দামের (এবং নিম্ন মানের)স্থানীয় কোম্পানিগুলি এভারেস্ট এবং সমগোত্রীয় সব ক’টি শৃঙ্গ পরিণত হয়েছিল ইন্ডাস্ট্রিতে বলা হয়েছিল, স্বপ্ন সম্ভবের যুগ এসেছে, ফেলো কড়ি চড়ো এভারেস্ট— ব্যস, তুমিও রাতারাতি পরিচিত হবে অভিযাত্রী হিসেবে বলা বাহুল্য, এমন বিজ্ঞাপনে এসেছিল প্রবল সাড়া তারপর সেই খদ্দের ধরে রাখতে, কয়েক বছর পার হতে না হতেই প্রয়োজন হয়েছিল ব্র্যান্ড এক্সটেনশনের ফলে সৃষ্টি হয়েছিলসেভেন সামিটস’, ‘এক্সপ্লোরার্স গ্র্যান্ড স্ল্যামগোছের গালভরা নামের প্যাকেজ ট্যুর প্রথম দিকে এই সব বিজ্ঞাপনের টার্গেট অডিয়েন্স সীমাবদ্ধ ছিল আর্থিক ভাবে সচ্ছল প্রথম বিশ্বের মানুষজনের মধ্যে এভারেস্টের এমআরপি ৬৫ হাজার ডলার ছুঁয়েছিল



১২- আর এখন বাংলার গ্রামের ছেলে বা মেয়েটি তার মায়ের গয়না, বাপের জমিজমা বন্ধক দিয়ে, যে-কোনও মূল্যে একটা আট হাজারের শিখরে উঠতে চাইছে কারণ, সে দেখতে পাচ্ছে এভারেস্ট বা সমতুল্য কিছু পাহাড়ে একবার উঠতে পারলেই টিভি এবং খবরের কাগজের হেডলাইন হওয়া এ পোড়া দেশে নিশ্চিত মিডিওক্রিটি থেকে মুক্তি পাবার এটা একটা নতুন শর্টকাট পর্বতারোহণের বাণিজ্যিক প্যাকেজিং-এর সাফল্য তাই আজ এক ছোঁয়াচে রোগ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এই সংক্রমণের জীবাণু ছড়াচ্ছে ভয়ঙ্কর দ্রুত হারে। দেখতেই পাচ্ছেন প্যাকেজিং-এর থাবা কে-টুকেও ছাড় দেয়নি।



১৩- সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবাংলা থেকে আটহাজারি শৃঙ্গ ‘জয়’ করতে যাওয়ার মিছিল তাই কোনও যুগান্তকারী ঘটনা নয়— বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় অযোগ্য, না হয় ট্যুরিস্ট ক্লাইম্বারদের ইগো ট্রিপ। বিগত তিন দশকে বিশ্ব জুড়ে পর্বতারোহণ দর্শনের দৈন্য দেখে ডগ স্কট তো একেবারে রাখঢাক না করেই বলেছেন, “যাদেরই পকেটে টাকা আর মনে ইনস্ট্যান্ট সেলিব্রিটি হবার শখ ছিল তারা তাদের সেই স্বপ্ন কিনতে পেরেছে”



১৪- তবে, বনিংটন-ডগ স্কটরা কী বলছেন এসব বিষয়ে কথা বলা আজ এই দেশ, বিশেষ করে এই রাজ্যে ভস্মে ঘি ঢালার সমতুল্য। মধ্যমেধার নবজাগরণ এবং তার গণ-উদ্‌যাপনের ফলে আজ নাভিশ্বাস উঠেছে পর্বতারোহণের দর্শনেরএদেশে যারা এভারেস্ট, কিংবা সমতুল ঘরানার কোনও পাহাড়ে ওঠেন তাঁরাই রাতারাতি পূজিত হন। সেই পূজা পর্বতারোহণ-মূর্খ কোনও সাংবাদিকের উচ্ছ্বসিত রিপোর্টেই থেমে থাকে না, খোদ সরকার বাহাদুরও এই দিগ্বিজয়ী বীরদের কখনও সম্মানীয় পদ, কখনও গোল্ড মেডেল ইত্যাদিতে ভূষিত করে থাকেন। একবারও ভাবা হয় না যে, এই স্বঘোষিত, দিগ্বিজয়ী অভিযাত্রীরা আসলে শেরপা এবং স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সির অ্যাডভেঞ্চার কেটারিং সার্ভিসের সম্মানীয় ক্রেতা। যুবসমাজকে একবারও ভেবে দেখার সময় দেওয়া হয় না যে, মাউন্টেন ট্যুরিজম এবং মাউন্টেনিয়ারিং— এই দু’টির মধ্যে তফাত আকাশ এবং পাতালের একই চিত্রনাট্য পুনরাবৃত্ত হয় ভারতীয় হিমালয়ে- মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবগুলির বাৎসরিক অভিযানেওশেরপারা রুট ওপেন করেন, রোপ ফিক্স করেন- বাবুরা বলেন করেছি। বলেন, ফিক্সড রোপে জুমার লাগানো দেখতে পাচ্ছেন তো কী হয়েছে, আসলে আমরা নিজেরাই ক্লাইম্ব করেছি; জুমার তো প্রপঞ্চময় মায়াসত্যি, কম ঝক্কি পোয়াতে হয় শেরপা ভাইদের! এক্সপিডিশন থেকে ফেরা বাংলার বনিংটনরা তার পর থেকে দূর্গাপুজার ফিতে ছাড়া আর কিছু কাটেন না এবং দেখা দেন আগামীকালের পর্বতারোহণের উপদেষ্টা, এমনকী, নীতিনির্ধারক রূপে সমস্যাটা এখানেই।



১৫- এদিকে বিশ্বের পর্বতারোহণ ম্যাপে যুক্ত হয়েছে নতুন এক শ্রেণি এঁরা নিজেদের মাউন্টেনিয়ার কিংবা অ্যাল্পিনিস্ট নয়, পরিচয় দিচ্ছেন মাউন্টেন অ্যাথলিটহিসেবে একের পর এক শিখর জুড়ে, তা আল্পসই হোক কিংবা হিমালয়, গত দশ বছরে আমরা স্পিড রেকর্ড ভাঙার প্রতিযোগিতা দেখছি ২০১৩ সালে, লোৎসে ফেসে উয়েলি স্টেক-সিমোনে মোরোদের সঙ্গে শেরপাদের হাতাহাতি-রেষারেষি পৃথিবীর সামনে এক চরম অস্বস্তিকর চিত্র তুলে ধরেছে। ফি বছর আরও বিচিত্র, আরও কঠিন, আরও দ্রুত গতির কিছু চমক জাগানো ক্লাইম্ব করাকে উয়েলি স্টেক বলতেন তাঁর ‘বিজনেস’। এভারেস্টের সেই তিক্ত ঘটনার পর ‘দি নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে উয়েলি স্টেক বলেছিলেন, “To make business, you need stories. To create stories, you need to come up with projects—bigger and bigger ones with each passing years—and then you need to succeed at them”



১৬- আমাকে ভুল বুঝবেন না। I respect everything in an athlete- strength, speed etc. আমার সঙ্গে যারা পাহাড়ে গেছেন তাঁরা জানেন ফিটনেসের ব্যাপারে আমি কতটা সিরিয়াস। কিন্তু আজ প্রতিনিয়ত এক-একজন মাউন্টেন অ্যাথলিটেরবিগার অ্যান্ড বিগার-এর পিছনে ছোটা দেখে কখনই ওয়াল্টার বোনাত্তির সেই উক্তি মনে পড়ে না: “What is there, beyond the mountain, if not the man?” ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আট হাজার মিটারের পাহাড় হোক কিংবা আল্পসের কোনও নর্থ ফেস, খবরে থাকার জন্য এই পর্বতারোহীরা যে-কোনও মাদারি-কা-খেল দেখাতে প্রস্তুত। তাই মাউন্টেন আথলিটদের বলছি- আপনাদের দায়িত্ব অনেক। ব্রুস লি- র কথা মনে রাখবেন।  



১৭-চীনের দিক থেকে কে-টু ক্লাইম্ব করা পোলিশ পর্বতারোহী দারিউস জালুস্কি আমাকে বলেছিলেন, “পাহাড় আমার স্টেডিয়াম নয়, পাহাড় আমার থিয়েটার দারিউসের কথায় আমার মনে পড়েছিল, ১৯৮৫ সালে গাশেরব্রুম-৪ শৃঙ্গের পশ্চিম দেওয়ালে আটকে পড়া আর এক পোলিশ পর্বতারোহী ভয়টেক কুর্তিকার কথা কুর্তিকা এবং রবার্ট শাউয়ার সেবার ওয়েস্ট ফেস ক্লাইম্ব করে ফেলেছিলেন, কিন্তু শিখর তখনও দূরে ছিল কুর্তিকা বুঝতে পেরেছিলেন, আর এগোলে মৃত্যু নিশ্চিত তাই দু’জনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নেমে আসার সামিটে না গেলেও বিশ্বের পর্বতারোহী মহল তাঁদের এই ক্লাইম্বকে অসম্পূর্ণ বলেননি সেই প্রসঙ্গে কুর্তিকা বলেছিলেন, “এর থেকে বোঝা যায়, অ্যাল্পিনিজম আসলে স্পোর্টনয়, এটি একটি আর্ট Only in art does a missing link contribute to the meaning of a piece” (অসম্ভবের সীমারেখায় ছবি আঁকা এই ক্লাইম্বিং রুট দেখে কেউ কেউ একে শতাব্দীর সেরা ক্লাইম্বতকমা দিতে চেয়েছিলেন তার জবাবে কুর্তিকা বলেছিলেন, “কোনও একটি বিশেষ কবিতাকে কি কখনও শতাব্দীর সেরা কবিতা বলা যায়?”)  



১৮- তাই, কুর্তিকা এবং দারিউসের দেখানো দর্শনের ওপর ভরসা রেখে, আজ মনে হয় আবার নতুন করে এক সরল এবং নান্দনিক স্বপ্ন দেখা শুরু করা যায়। ভেবে নেওয়াই যায়, জয়পতাকা ওড়ানোর অভিপ্রায়ে নয়, আবার একদিন বাংলায় সেদিন আসবে যেদিন অভিযান হবে নির্ভেজাল আনন্দের খোঁজে, শেখার আগ্রহে, নিজেকে একজন ক্লাইম্বার হিসেবে গড়ে তোলার হনেস্ট এফর্টে। শর্ট কার্ট দিয়ে নয় 



১৯- মনে রাখবেন আর্টের আগে প্রয়োজন ‘ক্রাফট’। তাই শরীরকে ট্রেন করবেন, নতুন টেকনিক শিখবেন। তারপর, নিজেদের ক্ষমতা, শৈলী এবং অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে প্রথমে ছোট ছোট শৃঙ্গ দিয়ে হাত পাকাবেন তাঁরা। তারপর একদিন কেবল গুটিকয় বন্ধু মিলে, পেল্লায় স্যাক কাঁধে তুলে নিয়ে, অপেক্ষাকৃত উঁচু পাহাড়ে, কঠিনতর ক্লাইম্বিং চ্যালেঞ্জের সন্ধানে পাড়ি দেবেন ঠিক যেমন ভাবে একদিন ফিনিক্সের মতো, পোলিশ অভিযাত্রীরা তাঁদের যাত্রা শুরু করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের বুক থেকে। পর্বতারোহণ সেদিন হবে আত্মিক উত্তরণের সোপান — আ সেলিব্রেশন অফ লাইফ ইটসেলফ।

সমাপ্ত

Tuesday, August 9, 2022

The old man and the bridge

I met an old man by the hanging wire bridge in the vale. 

We were traveling in the same direction, I could tell. 

As I slowed down with a smile, it was just a moment, but there we lived for a while. 

Only the hanging wire bridge knows our tale.

Saturday, August 6, 2022

ইচ্ছে হলে লিখব, না হলে লিখব না! 😆

'পাবলিশ অর পেরিশ-  Publish or Perish' 


ইন্টারনেট বলছে এই কথাটা নাকি ড্যানিয়েল জে বার্নস্টাইন নামের  সাম্প্রতিক সময়ের এক গণিতজ্ঞ বলেছেন। 


তবে আমার ধারণা ছিল কথাটা যথেষ্ট প্রাচীন এবং আমি মনে করি, কেবল তথাকথিত অ্যাকাডেমিয়া নয়, অভিযান সাধনাতেও এই কথা প্রযোজ্য। কারণ অভিযানের যাথার্থ শিক্ষায়, ট্রফি শিকারে নয়। 

(এক্ষেত্রে 'ট্রফি হান্টিং' কথাটা আমি আক্ষরিক কম এবং রূপকার্থে বেশী ব্যবহার করতে চেয়েছি। কারণ, আফ্রিকার কোন এক বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী শিকার এবং মাউন্ট এভারেস্ট আরোহণ- এই দুটিই আজ একই গোত্রে পড়ে গেছে। ) 



আপনি ঠিকই পড়েছেন, লেখার শুরুতেই  আমি 'অভিযান' শব্দটির পর 'সাধনা' শব্দটি ব্যবহার করেছি। কারণ আমি মনে করি, প্রকৃত অভিযাত্রীরা এক একজন সাধক।  গায়ক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানীদের মতই অভিযাত্রীরাও  কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন।  ফ্রাঁসোয়া আরাগো বলেছিলেন- " To get to know, to discover, to publish- this is the destiny of a scientist."  এবং বিশ্বকবির ভাষায় এই খোঁজ-  " আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না", কারণ- "এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।।

হ্যাঁ, অভিযাত্রীরাও কিছু সত্য, কিছু প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে আনেন এবং বিশ্বকে তা জানানোর চেষ্টা করেন।  সেই অনুসন্ধিৎসু 'পথ চলাতেই' তাঁরা 'আনন্দ' খুঁজে পান।  

রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টন, পরবর্তী কালে এরিক শিপটন, ফ্র্যাংক স্মাইথ এবং বিল টিলম্যানদের লেখা কেবল ' চাঁদ উঠেছে-ফুল ফুটেছে' কিংবা ' দুর্গম গিরি- চল জয় করি' নয়; বরং মানুষের সমাজ, বিজ্ঞান, দর্শন এবং আত্ম-জিজ্ঞাসার এক একটি দলিল। 

আমার এও মনে হয়, রিচার্ড বার্টনের (অভিনেতার কথা বলছি না) অভিযাত্রী স্পিরিট এবং কাজ নিয়ে বাংলা ভাষায় একটা কোন কম্প্রিহেন্সিভ কাজ হওয়া উচিৎ।  ওনাদের সময়ে ঔপনিবেশিক 'অ্যাডভান্টেজ এবং প্রিভিলেজ ছিল এবং তাহা অন্যায়'- এই বিচারধারাকে একটু সাইডে সরিয়ে রেখে করলে হয়ত এখনও অনেক কিছু শেখা সম্ভব। তবে অভিযাত্রীদের বিজ্ঞান সাধনা এবং অবদানের নিরিখে আমি ফ্রিৎসফ ন্যানসেন কিংবা  অ্যালেক্সান্ডার ফন হামবোল্টকে অনেক উচ্চ স্থানে রাখি।  এ প্রসঙ্গে একটি অসাধারন বইয়ের কথা উল্লেখ না করে পারা গেল না। বইটির নাম-  Measuring The World, লেখক ড্যানিয়েল কেলমান। পড়ে দেখতে পারেন। অনলাইনে পাওয়া যায়।  আর একটা অসাধারণ ওয়েবসাইটের খবরও আপনাদের দিয়ে রাখি- Explorers Podcast. বিশ্বের সর্বকালের সেরা অভিযাত্রীদের জীবন এবং তাঁদের কাজ এখানে পডকাস্টের আকারে রাখা আছে। বই পড়তে যখন ভাল লাগবে না, তখন চোখ বুজে শুনতে পারেন। ভাল লাগবে।

এই পডকাস্ট গুলো এক একটা ভ্যাক্সিনের মত। কূপমণ্ডূকতার অসুখ ধরবে না।   

( এজেন্সির প্যাকেজে অ্যাডভেঞ্চার কেনা লোকজন এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষকেরা এই কথার অর্থ বুঝবেন না।  তবে, ভবিষ্যতে তাঁদের জন্য কোনও আশাও নেই, ভালবাসাও নেই। কারণ আমি বিশ্বাস করি  আমাদের পরের প্রজন্ম প্রকৃত অ্যাডভেঞ্চারকে চিনে  নেবে এবং  তার সঠিক মুল্যায়ন করবে।) 
 
যাইহোক, এবার নিজের ঢাক নিজেই পেটানোতে আসি। 

যে কথা বলতে গিয়ে এতটা ভূমিকা করে ফেললাম তা হল- আমার নিজেরও একটি অভিযান ধারণা এবং সাধনা রয়েছে। তার বেশীর ভাগটাই এখনও লেখা হয়নি। হিমালয়ে আমার অভিযান এবং নতুন পথের অনুসন্ধান ইত্যাদি বিষয়ে 'দি হিমালয়ান জার্নাল' এবং 'দি আল্পাইন জার্নালে' আমার কয়েকটা রিপোর্ট ছাপা হয়েছে ঠিকই কিন্তু  বিস্তারিত এবং সর্বাঙ্গীণ ভাবে এখনও লেখা হয়নি। 

আমার আফ্রিকার কাজ এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের পথে চলার কাজ- এই গুলোই আপাতত ছাপা বই হিসেবে প্রকাশিত। 'কাজ'-ই বললাম, কারণ দুবার সাইকেল নিয়ে আফ্রিকার দুপ্রান্তে পাড়ি দেওয়া এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের যাত্রাপথ অনুসরণ করা - এগুলোর কোনটাই কোনও ট্রাভেল এজেন্সির প্যাকেজ ট্যুর ছিলনা। এই প্রত্যেকটা বেরিয়ে পড়াই জন্ম নিয়েছিল ভবঘুরের চরম কৌতূহল থেকে, কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার তাগিদ থেকে। 

'অতএব আফ্রিকা', 'আবার চাঁদের পাহাড়', 'গঙ্গা থেকে চিনশা', 'Sahara Soliloquies'  এবং 'দেশনায়কের পথে'-  আমার যেকোনো একটা বই পড়লেই দেখতে পাবেন এগুলো নিছক ভ্রমণ কাহিনী কম, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ অনেক বেশী।  

কোনোদিনই সংবাদ মাধ্যমে প্রচার কিংবা বিশেষ বই প্রকাশ অনুষ্ঠান- এই ধরণের কিছু আমার পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। তাই নিজের ব্লগ এবং সোশ্যাল মিডিয়াই আমার সম্বল।  এই মুহুর্তে যেসব বইগুলি অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর ছবি নীচে দিলাম।  বাংলা বইগুলি 'ছাপা বই'।  'Sahara Soliloquies'- Kindle eBook. বইয়ের ছবিগুলিতে ক্লিক করলে কেনার অনলাইন লিংক খোলা উচিৎ। 






পুনশ্চঃ 'সাহারা সলিলোকিস' এবং 'গঙ্গা থেকে চিনশা'-  এই দুটো বইকেই ছাপার ইচ্ছা রয়েছে। সময়, সুযোগ পেলেই হয়ে যাবে। এদিকে পেরুতে আমার অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে 'পেরুস্কোপ' লেখার কাজ শেষ। দেখা যাক কবে প্রকাশ পায় বই হিসেবে। আফটার অল- পাবলিশ, অর পেরিশ বলে কথা। তবে কোন 'প্রেসার' আমার ওপর নেই। 

ইচ্ছে হলে লিখব, না হলে লিখব না! 😆 
আর আপনারাও ইচ্ছে হলে পড়বেন, না হলে পড়বেন না। 

Discovering Ladakh’s Uncharted Petroglyphs : A Short Note

  Whispers on Stone: Discovering Ladakh’s Uncharted Petroglyphs We were trudging down a dusty trail by the frozen stream near the little v...